১৯৬৯ সালের ১৬ জুলাই। চাঁদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন নীল আর্মস্ট্রং। সঙ্গে আরও দুই মহাকাশচারী, এডুইন অলড্রিন এবং মাইকেল কলিন্স। আর ফিরে এলেন ঠিক ৮ দিন পর, ২৪ জুলাই। এমন ঘটনা তার আগে ঘটেনি। সারা পৃথিবীর মানুষ অবাক বিস্ময়ে দেখল তাঁদের চন্দ্র অভিযান। পৃথিবীর খুব কাছে থেকেও যে মানুষের অজানা অনেক প্রশ্ন চাঁদকে ঘিরে। কেমন দেখে এলেন তাঁরা? সেই বর্ণনা শুনতে অধীর আগ্রহে প্রত্যেকেই।
কিন্তু তার আগে একটু অপেক্ষা করতে হবে। কারণ তিন মহাকাশচারীকে কিছুদিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। হ্যাঁ, শুধু করোনা ভাইরাসের জন্যই না, সেদিন চাঁদে পা রাখার জন্যও কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়েছিল আর্মস্ট্রংদের। বলা যায় না, চাঁদের মাটিতে যদি থেকে থাকে কোনো সংক্রামক ভাইরাস! যদিও চাঁদে কোনো প্রাণের সন্ধান খুঁজে পাননি কেউই, কিন্তু ভালো করে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
এদিকে, তাঁরা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন কয়েকটা চাঁদের পাথর। এবার এই পাথর পরীক্ষা হবে কীভাবে? নাসার গবেষকরা সেই রাস্তাও বের করে ফেললেন। কিছু পাথর গুঁড়ো করে মিশিয়ে দেওয়া হল ইঁদুরের খাবারের সঙ্গে। তারপর তাদেরও রেখে দেওয়া হল আইসোলেশনে। এভাবেই অন্যান্য অনেক প্রাণীর উপরেও পরীক্ষা করা হয়। অবশেষে দেখা গেল, সেই পাথরগুলি একদমই নিরীহ। পৃথিবীর কোনো প্রাণীরই কোনো ক্ষতির সম্ভবনা নেই। অতএব সেই নমুনাগুলি রেখে দেওয়া হল।
তবে চাঁদের পাথরকে ঘিরে অনেক বিস্ময় তখনও বাকি ছিল। এমন জিনিস তো মানুষ আগে দেখেনি। নাসার পরীক্ষাগারে শুরু হল গবেষণা। কিন্তু সেই গবেষণায় ভাগ বসাতে চাইলেন অনেকেই। কেউবা স্রেফ নিজের সংগ্রহে রাখতে চাইলেন এমন বিরল পাথর। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সন্তু ও একটুকরো চাঁদ' গল্পটার কথা মনে আছে তো? কলকাতার প্রদর্শনী থেকে চুরি হয়ে গেল একটি চাঁদের পাথর। আর সেই তদন্তের ভার পড়ল কাকাবাবুর উপর। না, বাস্তবে কলকাতা থেকে কখনও কোনো পাথর চুরি যায়নি। তবে পৃথিবীর নানা জায়গাতেই এমন চুরির ঘটনা ঘটেছিল।
নীল আর্মস্ট্রংরা যে চাঁদের পাথরগুলি সংগ্রহ করে এনেছিলেন, সেগুলো সাধারণ মানুষ অন্তত চোখে দেখুক। মানুষের এটুকু চাহিদা মেটানোই যায় বলে মনে করেছিলেন নাসার গবেষকরা। তাই নানা জায়গায় শুরু হল প্রদর্শনী। আর এর মধ্যেই ঘটতে থাকলো একাধিক দুর্ঘটনা। তার বেশিরভাগই অবশ্য পরিকল্পিত চুরির ঘটনা। ১৯৬৯ সালেই মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে নিউজার্সি, ব্রাজিল এবং কানাডাতে পরপর চুরি গেল চাঁদের পাথর। পরবর্তীকালেও বহুবার এমন চুরির ঘটনা ঘটেছে। বেশিরভাগই আর ফিরে পাওয়া যায়নি। নাসার নিজস্ব রিপোর্ট অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত ৫১৭টি চাঁদের পাথর চুরি গিয়েছে অথবা হারিয়ে গিয়েছে। এর প্রত্যেকটা অবশ্য নীল আর্মস্ট্রং নিয়ে আসেননি।
আরও পড়ুন
চাঁদের মাটিতে শেষতম মানুষ জিন সারনান, লিখে আসেন মেয়ের নাম
এর মধ্যে অনেক পাথর আবার পরে খুঁজেও পাওয়া গিয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি হল আলাস্কা ট্রান্সপোর্টেশন মিউজিয়ামের ঘটনাটি। ১৯৭৩ সালে প্রদর্শনী চলাকালীন হঠাৎ আগুন লাগে মিউজিয়ামে। আর তখনই হারিয়ে যায় একটি পাথর। সেই পাথর আবার খুঁজে পাওয়া গেল ২০১০ সালে। দীর্ঘ দুবছর ধরে পরীক্ষার পর প্রমাণ হল এই সেই হারিয়ে যাওয়া চাঁদের পাথর। আরকানসাসের বাটলার সেন্টার থেকে ১৯৭৬ সালে চুরি যাওয়া পাথরটি পাওয়া যায় ২০১১ সালে। এমনকি ২০০০ সালের পরেও বহুবার এমন চুরির ঘটনা ঘটেছে। শুধু প্রদর্শনীর সময় চুরি নয়, অনেক সময় গবেষণার মধ্যে থেকেও চুরি গিয়েছে চাঁদের পাথর। তেমনটাই দাবি নাসার আধিকারিকদের। সব মিলিয়ে ৫১৭টি নমুনা খোয়া যাওয়া একেবারেই মুখের কথা নয়।
আরও পড়ুন
চাঁদে মানুষের পা, নাকি স্টুডিয়োয় শুটিং? কুবরিকের দাবি ও অন্যান্য রহস্য
১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে ১২ জন মহাকাশচারী চাঁদে গিয়েছেন। তাঁরা সবসুদ্ধ ২৬ হাজারের বেশি চাঁদের পাথর সংগ্রহ করে এনেছেন পৃথিবীতে। সেইসব নমুনার গবেষণার পাশাপাশি তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার দায়িত্বও নাসার। ২০১৫ সাল থেকে তাই সমস্ত ধরনের প্রদর্শনী নিষিদ্ধ। গবেষণার জন্যও নানা কড়াকড়ি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। আজকাল আপনি আর চাইলেই চাঁদের পাথর দেখতে পারবেন না। তবে বছর পঞ্চাশ আগেও মানুষ লাইন দিয়ে সেই পাথর দেখেছেন। আর তাকে ঘিরে অজস্র কাহিনি, এমনকি সিনেমাও তৈরি হয়েছে। আর বহু কাহিনিতে মিলেমিশে গেছে বাস্তব ঘটনার অনুষঙ্গও।
Powered by Froala Editor