পঞ্চম পর্ব
১৯৩৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, “এই টলমল অবস্থায় এখনকার মত দুটো পাকা ঠিকানা পেয়েছি আমার বানপ্রস্থের— গান আর ছবি।” অন্যত্রও ছবিকে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘শেষ বয়সের প্রিয়া’ বলে, আর গান তো তাঁর ‘অহংকারের বিষয়’- “আমি জানি সেখানে আমার একটা বিশেষত্ব আছে। আমি আপনার একটা objective মনস্তত্ত্বের একটা দৃশ্য পাই।” অর্থাৎ প্রাণের নিভৃত স্তরের গান যখন বস্তুজগতের চিত্ররূপ নিয়ে জেগে ওঠে, তখন ছবির জন্ম। গান আর ছবিকে শেষ বয়সের আশ্রয় করে নিতে চাওয়ার মধ্যে কি নান্দনিকতার গভীরতর কোনো উপলব্ধির ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন কবি? গান থেকে ছবি হয়ে ওঠার এই খেলাতেও বার বার ফিরে এসেছে বাদল দিন, মেঘলা আকাশ আর শ্যামা প্রকৃতির চিত্রকল্প।
চিত্র আর কাব্য যে পরস্পরের পরিপূরক, এ-কথা নন্দনতত্ত্বের দৃষ্টিতে স্বীকৃত - তা প্রাচ্যে হোক বা পাশ্চাত্যে। কাব্য যদি হয় চিত্রে্র ‘সঙ্গিনী-কলা’, তাহলে সঙ্গীত তো তার সাথে আরও ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের দাবি রাখে। কবিতা দিয়ে কিভাবে রং ছড়ানো যায় চেতনার ক্যানভাসে, তা বোঝাতে হয়ত ক্লাসরুমের অভিজ্ঞতা লাগে, কিন্তু একটি গান অনেক সহজে জাগিয়ে দিতে পারে সেই অপরা অনুভূতি। ‘গগনে গগনে আপনার মনে’ গানটির কথাই ধরা যাক। ‘জটার গভীরে লুকালে রবিরে/ ছায়াপটে আঁকো এ কোন্ ছবিরে’- ‘গভীরে’, ‘রবিরে’, ‘আঁকো’, ‘ছবিরে’- প্রতিটি শব্দের শেষ অক্ষরে পাঁচ মাত্রার টান, সুর প্রায় অচঞ্চল- দাঁড়িয়ে থাকছে এক-একটি নির্দিষ্ট পর্দায়, যেন এক-একটা লম্বা তুলির টান। মেঘের জটা ঢেকে ফেলছে সূর্যকে, কিন্তু পুরোপুরি অন্ধকার নয়। একটুখানি সোনালি-শুভ্র আভা, আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে নীলচে সবুজ মেঘলা রঙে, ‘সে সোনার আলো শ্যামলে মিশালো/ শ্বেত উত্তরী আজ কেন কালো’। সুরের চলনে আবার সেই দীর্ঘ মাত্রার প্রয়োগ, যেন রং মিলিয়ে দিচ্ছেন শিল্পী তুলির বিলম্বিত আঁচড়ে। সব মিলিয়ে এই আলো আঁধারি খেলায় ছবিখানা আঁকা হল অসাধারণ; প্রকৃতি মেঘের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছে তার শিল্পীরূপের ঐশ্বর্য, ‘লুকালে ছায়ায় মেঘের মায়ায় কী বৈভব’। একাধিক স্পর্শস্বরের ব্যবহার ‘কী বৈভব’ অংশটিকে করে তুলল মুগ্ধ বিস্ময়ের দ্যোতক।
রবীন্দ্রনাথের ছবির মনোযোগী দর্শক নিশ্চয় খেয়াল করেছেন, কবি তাঁর শেষবয়সের এই ‘প্রিয়া’কে রাঙিয়েছেন অনেকখানি কালো আর এক ধরনের অদ্ভুত লালিমায়- সে রং কখনও আগুনে লাল, কখনও রক্তকরবীর পাপড়ির মতো নেশা ধরানো, কখনও আবার লজ্জায় ঈষৎ রাঙা। তাঁর ছবিতে এই রং দুটির খেলা যেন নিয়ে যেতে চায় এক দুর্জ্ঞেয় রহস্যের জগতে- ‘দৃশ্য’ ছবির স্তর থেকে গভীরতর জগতে। তবে সে জগতকে অনুভবে পাওয়ার সেতু হয়ে উঠতে বুঝি গানই পারে। ‘ছবি ও গান’ থেকে রবীন্দ্রনাথের কবিতায় যে চিত্ররূপময়তা স্পষ্টতর হয়েছে, তা যেন সবচেয়ে বেশি করে ধরা পড়ে তাঁর প্রকৃতি ও বিচিত্র পর্যায়ের গানে। গান থেকে ছবি হয়ে ওঠার লীলায়, বিশেষ করে শ্রাবণের গানে এই দুটি রংকে মিশে থাকতে দেখি বারবার- ‘এই শ্রাবণের বুকের ভিতর আগুন আছে।’ শ্রাবণের মেঘাচ্ছন্ন কালো রূপের মধ্যে যে প্রবল সৃজনী-জীবনী শক্তির উচ্ছ্বাস, তার চিত্ররূপ ধরা পড়ে আগুনের শিখায়। ‘ও তার শিখার জটা ছড়িয়ে পড়ে দিক হতে ওই দিগন্তরে/ তার কালো আভার কাঁপন দেখ তালবনের ওই গাছে গাছে’- এ তো শুধু গান নয়, ছবিও। ছবিটা আরও রঙিন হয়, যখন সেই আগুনের আভাতেই কদম্ববনে লাগে সোনালি-লালিমার ছোঁয়া। বিশেষ করে সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে এ গান শুনলে মনে হয়, এক অরূপরতনের চেতনা রূপ নিচ্ছে এই শ্রাবণের আগুনে চেহারায়- সেই অন্ধকারের রাজাও তো সুদর্শনাকে প্রথমবার দেখিয়েছিলেন তাঁর ‘অনুপম’ কালো রূপ, আগুনের মধ্যেই। হয়ত এই ভাবনা অতিদূর-কল্পনায় আচ্ছন্ন, এবং নিতান্তই ব্যক্তিগত।
গান থেকে যেমন ছবি পাই, ছবি থেকে আবার গান হয়ে ওঠা- ‘সেই আগুনের বেগ লাগে আজ আমার গানের পাখার পাছে’। ভুললে তো চলবে না, সুচিত্রা মিত্র কেবল শান্তিদেব ঘোষের নন, রামকিঙ্কর বেজেরও ছাত্রী! ছবি আঁকার চর্চা আবার ধরেছিলেন শেষ বয়সে। আর একটি এমন ছবি আঁকার গান তাঁর কণ্ঠে স্মরণীয়- ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’।
আরও পড়ুন
‘সে কথা আজি যেন বলা যায়…’
রবীন্দ্রসঙ্গীতের পুরোধা শিল্পীদের মধ্যে এ গানের অন্যতম বিশিষ্ট রূপকার শান্তিদেব ঘোষের লেখায় পাই, ১৯৩১ সালে বর্ষামঙ্গল অনুষ্ঠানের জন্য ‘ক্ষণিকা’ কাব্যগ্রন্থের ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতাটিতে সুর দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, “নানা রাগিণী মিশিয়ে”। সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায়, “এই গানে ভবিষ্যৎ সুরকারদের জন্যে নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত রেখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ। কথকতার ঢঙ নিয়েও যে গানে কত রকমের বৈচিত্র্য আনা যেতে পারে, তার পরিচয় পেয়ে বিস্ময় জাগে।... গানটিতে সুর বলতে প্রায় কিছুই নেই, কেবল এখানে ওখানে একটু-আধটু কেদারা, মল্লারের রেশ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। কীর্তন ও বাউল সুরের ছোঁয়াও আছে। ‘কালো’ কথাটিকে ব্যবহার করলেন ঠিক সেই ভাবে যেভাবে আমরা কথা বলি। সবটা মিলিয়ে যা হল তা বাংলা গানের অজানা সম্ভাবনার দিকে ইঙ্গিত করছে।(‘রবীন্দ্রনাথের গান’)অনেক সঙ্গীতজ্ঞ আবার এর মধ্যে কানাড়া রাগের ছোঁয়াও পেয়েছেন। ব্যালাডধর্মী বর্ণনামূলক একটি কবিতা, মূল আবেদন কিন্তু লুকিয়ে আছে ‘ছবি’ হয়ে ওঠায়।
এই ছবি আঁকার কাজটিই সুচারু ভাবে সম্পন্ন করেছেন সুচিত্রা, তাই তাঁর পরিবেশনে গানটি জনপ্রিয় হয়েছে সহজেই। গানটি অর্ধঝাঁপ তালে বাঁধা হলেও শান্তিদেব বা সুচিত্রা সে পথে যাননি, গেয়েছেন বিকল্প মুক্তছন্দে। সুচিত্রা মুক্তছন্দকে গানের পরিসর পেরিয়ে ছড়িয়েছেন ক্যানভাসে। এক-একটি স্তবক তিনি গেয়ে চলেন, আর সেই সঙ্গে শ্রোতার মনের ক্যানভাসের এক-এক কোণ ভরে ওঠে। কালো মেয়ের ছুটে আসা, তমাল বনে কালো কোমল ছায়াপাত- এসব কিছু মিলে ছবিটা পূর্ণতা পায় যখন- জেগে থাকে একটিই অনুভূতি, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’- ঝোঁক পড়ে ‘কৃষ্ণকলি’ আর ‘তারেই’ অংশে। সেই মেয়েটি কৃষ্ণকলি, কিন্তু ‘আমি’ কে? বোধহয় শিল্পী নিজেই। আর তাই বোধহয় এক অনুষ্ঠানে যখন ‘কৃষ্ণকলি’ গাইবার অনুরোধ আসে, সুচিত্রার তখন সে গান গাইবার ‘মুড’ না থাকলে তিনি বলেন, ‘কৃষ্ণকলি ট্রেনে রিজার্ভেশন পায়নি। আপনারা বরং বসন্তের গান শুনুন।’ প্রিয় গান, নিজের বিখ্যাত গান বলেই যে সবসময় সেই গান গাইতে হবে, তার কী মানে আছে!
আরও পড়ুন
‘ওগো আমার শ্রাবণ মেঘের খেয়াতরীর মাঝি’..
এ গান গেয়েছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও, তবে রেকর্ড করেছেন অনেক পরে। ‘সুচিত্রার গান’ বলেই যে তাঁর এই সঙ্কোচ, সেকথা স্বীকারও করেছেন। তবে গানটা যে তাঁর ‘মনের মধ্যে অনেকদিন ধরেই ছিল’, তাও জানাতে ভোলেননি। আর ভুলে গেলেও মনে করিয়ে দেবার জন্য আছে অনেক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ - কীভাবে তিনি বিয়ের বাসরে, কখনও বা ঘরোয়া আসরে অবাঙালি অনুরাগীর অনুরোধে শুনিয়েছেন ‘কালা লেড়কি’র গান, কেমন করে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সামলাতে মঞ্চে উঠে ধরেছেন ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’। আর সে গান যখন সুচিত্রা শুনলেন, কী ঘটল? শঙ্করলাল ভট্টাচার্য লিখেছেন, “ক্যাসেটের শারদ সম্ভারের উদ্বোধন আয়োজন করেছিল সাউন্ড উইং সংস্থা দক্ষিণ কলকাতার পল ম্যানসনে, ’৮৭ কি ’৮৮ সালে। একেবারে শেষে ওরা বাজাল ‘সত্তর দশকের হেমন্ত’ নামের ক্যাসেট থেকে ‘কৃষ্ণকলি’ গানটা। সাউন্ড সিস্টেমে গানটা আসতেই গোটা ঘরে পিন পড়া নিস্তব্ধতা। ...গান যত এগোচ্ছে আমি দেখছি সুচিত্রাদির চোখ দু’টো জলে ভরে আসছে। ...গানটা তো শান্তিদেব আর ওঁর নামের সঙ্গেই জুড়ে আছে এত দিন। সেখানে নতুন এক অবতারের জন্ম হচ্ছে ... গান শেষ হতে উনি চোখ চাপা দিয়ে পাশের একটা ঘরে গিয়ে বসে পড়লেন। ওঁর আনন্দাশ্রুও উনি কারও সামনে নিক্ষেপ করতে চাইছিলেন না।” পরে সে কথা হেমন্তকে বলায় অস্বস্তিতে পড়েন তিনি, বলেন- “ওটা সুচিত্রার গান। তাই গাই না। ও গান সুচিত্রারই থাক। তোমরা আমার ক্যাসেটটা[ও] শুনো।”
‘কৃষ্ণকলি’ গাইতে গিয়ে ছবি এঁকেছেন হেমন্তও। ছবি তিনি এমনিতেই আঁকেন গান দিয়ে, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান যে কটি গেয়েছেন, তার মধ্যে নিজেকে সুরচিত্রকর হিসেবেই তুলে ধরেছেন। ‘কৃষ্ণকলি’ প্রসঙ্গে নিজেই বলে গেছেন, “আমি কবিতাটা যা বুঝেছি, তার মধ্যে আমি একটা ছবি পাই। সেই ছবিটা আমি আস্তে আস্তে... এঁকে দেবার চেষ্টা করেছি”। সুচিত্রা ছবি আঁকেন স্তবক ধরে ধরে, আর তাঁর বন্ধু এঁকেছেন প্রতিটি পঙক্তিতে। সুচিত্রার গানে ঘন মেঘে আঁধার হয়ে আশা আকাশ, ধানের ক্ষেতে পুবের বাতাসে ঢেউ খেলে যাওয়া, কালো মেয়ের আকাশ পানে তাকানো- এসব আমরা দেখতে পাই। আর হেমন্তর আঁকা ছবির মধ্যে আমরাও ঢুকে পড়ি, অনুভব করি সেই ঢেউ খেলানো ধানক্ষেতের মীড়, কেমন করে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ় হয়ে শেষ পর্যন্ত “শ্রাবণ রজনীতে” বুকের মাঝে ঘনিয়ে আসা ‘হঠাৎ খুশি’র শরিক হয়ে পড়ি অজান্তেই।
আরও পড়ুন
“আমি শ্রাবণ আকাশে ওই দিয়েছি পাতি...”
সুচিত্রার ছবিতে ফোটে বাস্তবের বর্ষা-প্রকৃতির ছবি, তাতে মাখানো থাকে বিচিত্র-পর্যায় সুলভ নান্দনিকতার উজ্জ্বল রং, হেমন্তের আঁকা ছবিতে একই সঙ্গে ফোট আপাত-সরল পল্লী-পরিবেশের সঙ্গে মিশে থাকা বাস্তবের প্রতিচ্ছায়া আর অভিব্যক্তি। বর্ষার আমেজ ফোটে যখন তিনি গলার আওয়াজে তুলে আনেন ‘মেঘের গুরুগুরু’; মরমিয়া বিস্ময়ে পাঁচ বার পাঁচরকম করে ওই ‘কালো’ ডাক আমাদের নিয়ে যায় বিচিত্র থেকেও বিচিত্রাতীত এক মুগ্ধতায়, যার নাম প্রেম, অথবা তার চেয়েও গভীর এক রহস্যের অনুভূতি। ‘আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে/ আমি জানি, আর জানে সেই মেয়ে’- এ কথা জানার অধিকার কি শুধু তাঁর, না প্রত্যেক শ্রোতার? শ্রোতার মুগ্ধতা, বিস্ময়কে কি শিল্পী নিজেই আধান করেন না তাঁর ‘আঁকা’ ও ‘দেখা’য়? গানে কানাড়া, মল্লার না কেদারা, কীর্তন না কথকতা কোথায় ফুটল, সে কথা মনেই থাকে না আর। বরং গানটা শেষ হবার অনেকক্ষণ পরে মনে পড়ে স্বয়ং স্রষ্টার বলে যাওয়া কটি কথা, “নামের মধ্যে তর্কের হেতু থাকে, রূপের মধ্যে না। কোন রাগিণী গাওয়া হচ্ছে বলবার কোন দরকার নেই। কি গাওয়া হচ্ছে সেইটেই মুখ্য কথা, কেননা তার সত্যতা তার মধ্যেই চরম। … কলিযুগে শুনেছি নামেই মুক্তি, কিন্তু গান চিরকালই সত্যযুগে।”(ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠি, ১৩ জানুয়ারি ১৯৩৫)
রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান বোধহয় এজন্যই চিরকালের সত্য- স্থান, কাল ও বিশ্লেষণের গণ্ডি ছাড়িয়ে সে গান জেগে থাকে বুকের মাঝে। বাইরের প্রকৃতিতে বাদল ধারার কাল সারা হলেও, চেতনার আলোতে মিশে থাকে তার আভাস, বৃষ্টির বিন্দুর মতো।
আরও পড়ুন
“আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান…”
Powered by Froala Editor