‘সে কথা আজি যেন বলা যায়…’

পর্ব-৪
বাংলা ক্যালেন্ডারের তারিখ মেনে বিদায় নিয়েছে শ্রাবণ মাস। কিন্তু কবির দৃষ্টিতে শ্রাবণ তো শুধু একটি মাসের নাম নয়, শ্রাবণ এক ভাবের নাম, শ্রাবণ এক গভীর বোধের নাম। তাই ফাল্গুনে লেখা গানেও মিশিয়ে দেন তিনি শ্রাবণ-মেজাজ, শরতের গানের কলিতেও ভুলতে পারেন না তাকে – ‘ফাল্গুনে শ্রাবণে কত প্রভাতে রাতে/ আমার রাত পোহাল শারদপ্রাতে।’ 

এমনই এক ফাল্গুনে লেখা শ্রাবণের গান, ‘শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে’, রচনার তারিখ ১৩২০ সনের ২৫ ফাল্গুন। গানটি রবীন্দ্রনাথ নিজে গেয়েছিলেন জাহাজে জাপান-যাত্রার পথে- এক প্রবল ঝড়-বাদলের রাতে(১৩২৩ সনের ৯ জ্যৈষ্ঠ)। “কাল সমস্ত রাত বৃষ্টি বাদল গিয়েছে, কাল বিছানা আমার ভার বহন করে নি, আমিই বিছানাটাকে বহন করে ডেকের এ ধার থেকে ওধার আশ্রয় খুঁজে বেড়িয়েছি। রাত যখন সাড়ে দুপুর হবে, তখন আর বাদলের সাথে মিথ্যা বিরোধ করার চেষ্টা না করে প্রসন্ন মনে তাকে মেনে নেবার জন্য প্রস্তুত হলাম। একধারে দাঁড়িয়ে ঐ বাদলার সঙ্গে তান মিলিয়েই গান ধরলাম, ‘শ্রাবণের ধারার মত পড়ুক ঝরে’।”(‘জাপান-যাত্রী’) 

গীতা ঘটক, কলিম শরাফি, ঋতু গুহ-র মত বরেণ্য শিল্পীদের কণ্ঠে বহুবার শোনা - এ এক পূজা-প্রার্থনা পর্যায়ের গান, যেখানে কবি তাঁর অন্তরতমকে ডেকে বলছেন, আমার এই জীবনের সুখের ’পরে, ’দুখের পরে, সকল চাওয়া পাওয়ার ’পরে তোমার সুর ঝরিয়ে দাও, শ্রাবণের ধারার মত। কলিম সাহেব যখন গেয়ে ওঠেন, ‘যা কিছু জীর্ণ আমার দীর্ণ আমার জীবনহারা’ তখন পূজা পর্যায়ের ভাবটি চরম নিবেদনের পূর্ণতা পায়। ভাবতে অবাক লাগে, পূজা পর্যায়ের গানে রবীন্দ্রনাথ কত সহজে ‘ক্ষুধা’ বোঝাতে ব্যবহার করেছেন ‘ভুখ’ শব্দটি- যা “বর্ণনীয় ভাবের সহায়তা”য় অনবদ্য। গীতা ঘটক যখন স্পষ্ট উচ্চারণে গান, ‘ভুখের ’পরে’, তখন মনে হয় ক্ষুধার চেতনা একই সঙ্গে শরীরী এবং দেহাতীত হয়ে ওঠার জন্য এমন একটি শব্দেরই প্রয়োজন ছিল। 

রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্তর্নিহিত পর্যায়-সম্মিলন ও ভাব-সম্মিলনের স্রোতে একদিকে যেমন পূজার গান হয়ে উঠেছে বর্ষার ভাববাহী, তেমনি বর্ষার গান বাদল হাওয়ায় পাড়ি দিয়েছে অপার্থিব, অনির্বচনীয়ের উদ্দেশে। ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’ যখন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শুনি, প্রথম কলিটি গাওয়ার সাথে সাথেই এক মেঘে-ছাওয়া স্নিগ্ধ, গভীর একাকিত্বের, বিরহের ভাব ঘনিয়ে আসে। ‘আমায় কেন বসিয়ে রাখো’, ‘তুমি যদি না দেখা দাও,... কেমন করে কাটে আমার ব্যাকুল বাদল বেলা’- এমন প্রশ্নের বিলম্বিত উচ্চারণে যে সুরেলা আর্তি, তা প্রকৃতি পর্যায়কে ছাপিয়ে পূজায় রূপ নেয় অনায়াসে। 

কণিকার ‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’তে যে মেঘ, তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন মেজাজের মেঘকে পাই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায় ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’র উচ্ছ্বাসে- যা প্রকৃতির মধ্যে এনে দেয় বিচিত্র পর্যায়ের আমেজ। সাগর সেনের গাওয়া ‘আজি বারি ঝরে ঝর ঝর ভরা বাদরে’ গানটিও দ্রুত ছন্দে প্রকৃতির বুকে বর্ষা নেমে আসার দৃশ্যকে মিলিয়ে দেয় বিচিত্রে। চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় যখন ‘কেটেছে একেলা বিরহের বেলা’র সঞ্চারীতে ধরেন, ‘বাহির আকাশে মেঘ ঘিরে আসে’, তখন মেঘ হয়ে ওঠে এক মরমিয়া রোম্যান্টিকতার আশ্রয়। তাঁর ‘যেদিন ভেসে গেছে চোখের জলে’ আবার বর্ষা-প্রকৃতিকে সাথী করে বিরহখিন্ন প্রেমের কথা বলে ওঠে। অন্যদিকে, ‘গানের সুরের আসনখানি’র সঞ্চারীতে যখন ‘আজ সকালে মেঘের ছায়া লুটিয়ে পড়ে বনে/ জল ভরেছে ওই গগনের নীল নয়নের কোণে’ গেয়ে ওঠেন সুচিত্রা মিত্র, মনে হয় গানটাই যেন বর্ষার তালে তালে লুটিয়ে পড়ছে পূজার অর্ঘ্য রূপে। একই গান মুক্তছন্দে গেয়েছেন দেবব্রত বিশ্বাস, তাঁর গলায় ‘মেঘলা গানের বাদল অন্ধকার’ ঘনায় ধীরে ধীরে, আকাশ-ঝেঁপে বৃষ্টি নামিয়ে দেয় না, বরং থমকে দাঁড়ায় প্রকৃতি। 

বর্ষাকে বুকের ভিতর রেখে এমন করেই বার বার প্রকৃতি থেকে বিচিত্রে, প্রেমে, প্রেম থেকে পূজায় পাড়ি দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের গান, আর সেই রূপক-যাত্রা এক বাদল-সন্ধ্যায় ‘অন্তবিহীন পথ’ পেরিয়ে আসা পথিকের অভিসারের মতই। ‘মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম’ প্রকৃতি-বর্ষা পর্যায়ের গান। কিন্তু যে গান গাইতে গেলে শিল্পীকে গলায় আনতে হয় ‘মরুতীর হতে সুধাশ্যামলিম পারে’ উত্তরণের আকাঙ্ক্ষা, পথ হতে কুড়িয়ে, গেঁথে আনতে হয় সিক্ত যূথীর মালা, যাতে ‘সকরুণ নিবেদনের গন্ধ ঢালা’- সে গানে কি প্রেম আর পূজার দিব্য-রসায়ন ঘটে যায় না বর্ষা-প্রকৃতির ছায়ার অন্তরালে? গান বাঁধা হল পিলু-দাদরায়, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজেই তো বলে গেছেন- রাগরাগিণীর শাস্ত্রীয় বিশুদ্ধতার চেয়েও অনেক বড় সত্য গানখানা, তার বাণীময় ভাবরূপ, তার সুরের সমগ্রতা – “মনের মধ্যে ওর যে প্রেরণা তা ব্যাখ্যার অতীত”। এ বিষয়ে তিনি নিজেকে ‘উদ্ধত, স্পর্ধিত’ বলতেও ছাড়েন নি (অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা চিঠি, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৯)। তাই পিলু দিবা তৃতীয় প্রহরের রাগ হলেও তাকে ব্যবহার করেছেন সন্ধ্যার পটভূমিতে- যে অন্ধকারে সজল মেঘের ছায়া ঘনায়, নিভৃতে প্রদীপ জ্বলে। সেই অন্ধকার আর সন্ধ্যার ঘনীভূত রূপ সুরে সুরে ধরা দেবে কণ্ঠে, তবে তো গান হয়ে উঠবে সে সুর, পাতায় লেখা স্বরলিপি-তাল-রাগের নির্দেশ থেকে। দাদরা দ্রুতলয়ের তাল হিসেবেই সচরাচর ব্যবহৃত, এখানে কিন্তু মধ্য লয়ে, খানিক বিরতি নিয়ে সেই পথশ্রমের ক্লান্তি আর ক্লান্তি-ছাপিয়ে জেগে থাকা সমর্পণের আবেগ ফুটতে হবে শিল্পীর নিবেদনে। ‘সকরুণ নিবেদনের’ (ধা ণা ণা ণা ণা ণা ণা ণা) আর ‘দূর হতে আমি দেখেছি তোমার’ (না –া না না না না ধনা না না না না র্সা) অংশে কোমল আর শুদ্ধ নিখাদে একই পর্দায় সুর দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখা- এক-একটি শব্দের অনুরণনকে শান্ত, সমাহিত করে রাখার আবেদনে অমোঘ। ‘আমার এ আঁখি উৎসুক পাখি ঝড়ের অন্ধকারে’ গাওয়ার সময় সেই প্রায়-নিস্তরঙ্গ,  স্বরের বুকে কাঁপন ধরবে, যেন ঝড়ে দিশাহারা পাখির উৎকণ্ঠা- আবার মিলিয়ে যাবে আবর্তনে, ‘মনে হল যেন পেরিয়ে এলেম... আসিতে তোমার দ্বারে।’ কে আসে, কার দ্বারে? এ কি নিছক বর্ষারাতের অভিসার, নাকি ‘জীবন-মরণের সীমানা ছাড়ায়ে’ এক অনন্ত-যাত্রার পরিণতি খোঁজা?       

এক আশ্চর্য ব্যক্তিগত অনুভূতির কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। এ গান ১৪ বছর বয়সে প্রথমবার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে শুনে কেন জানি না এইসব ভাবনাই জেগেছিল মনে, অজান্তেই বুকের মধ্যে নেমেছিল বর্ষা, চোখের কোণে মেঘ- কিন্তু তখন এ অনুভব প্রকাশ করতে গেলে ভাবনা অসহায়ের মত হার মানত ভাষার দৈন্যে। এখনও তাই, তবে তখন যে তথ্যটি জানা ছিল না, এখন বই-ঘাঁটা ‘বিদ্যে’য় তা জেনেছি বলে হয়ত অতখানি অসহায় লাগে না- গানটি কবি লিখেছিলেন ১৩৪২ সনের ২২ শ্রাবণ। অপার্থিব ষড়যন্ত্র!  

‘মনে হল যেন’ যখন লেখেন রবীন্দ্রনাথ, তখন তাঁর বয়স চুয়াত্তর। এই পর্বের গানে প্রকৃতির সঙ্গে প্রেম ও পূজার ভাবসম্মিলন খুঁজতে যাওয়া খুব স্বাভাবিক। আর একটি গানের কথায় আসি- ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’। কবির ২৮ বছর বয়সে, ১২৯৬ সনের ৩ জ্যৈষ্ঠ পুনেতে বসে লেখা প্রেম পর্যায়ের গান। ‘মানসী’ কাব্যগ্রন্থের ‘বর্ষার দিনে’ কবিতার গীতিরূপ। রাগ মিশ্র-মল্লার, তাল তেওড়া; মতান্তরে দেশ রাগ, রূপক তাল। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ইন্দিরা দেবীর করা স্বরলিপিতে ভিন্নতা দেখা যায়। বৃহত্তর সমাজে রবীন্দ্রসঙ্গীতের জনপ্রিয়তা আরম্ভের যুগে, পথিকৃৎ শিল্পীদের মধ্যে পঙ্কজকুমার মল্লিকের কণ্ঠে গানটির রেকর্ডিং স্মরণীয়। পরে এ গান গেয়েছেন দেবব্রত বিশ্বাস, এবং- হেমন্ত মুখোপাধ্যায়...
এত যে তথ্য দেওয়া হল, গানটাকে ধরা গেল না তো! গানটা কি বলতে চায়, একটু শুনে দেখলে হয় না?
এমন দিনে তারে বলা যায়। কেমন দিন? এমন ঘনঘোর বরিষায়- অর্থাৎ সময়, দিন অনির্দেশ্য। মাসটা শ্রাবণ না হয়ে জ্যৈষ্ঠ বা যা খুশি হোক, জায়গা পুনে না হয়ে শান্তিনিকেতন, কলকাতা, শিলাইদহ- অন্য কিছু হলেও কিছু আসে যায় না, শুধু চারদিক থেকে ঘনিয়ে আসা ‘তপনহীন ঘন তমসা’র আবরণখানি সত্য। এই অন্ধকারের মাঝে বৃষ্টি নামায় মেঘের মত এক স্বর, ‘এমন মেঘস্বরে বাদল ঝরো ঝরে’। এমন দিনেই তো তারে বলা যায়- সেই কথা, যা আর কেউ শুনবে না, শুধু দুজনের সেই কথা। 

কে এই দ্বিতীয়জন? কবির মানসী প্রিয়া? তাই যদি হয়, তবে মানসী থেকে জীবনদেবতা হয়ে ওঠা তো শুধুই বোধের অপেক্ষা। এই নিভৃতে, নির্জনে ‘তাকে’ পাওয়ার কামনা এখনও ‘আমির আবরণ’-এ ঢাকা, তবে সে আবরণ ক্ষয় হতেও বেশি দেরি নেই। তাই পরের স্তবকে ‘সমাজ সংসার মিছে সব/ মিছে এ জীবনের কলরব’-এ সুরের ক্রমঊর্ধ্বায়নে কণ্ঠের যে ব্যাপ্তি, তাতে যেন কেমন ‘সংসার যবে মন কেড়ে লয়’-এর ‘নিবিড় প্রেমের সরস বরষা’ নেমে আসার পূর্বভাবের আভাস! কেবলি আঁখি দিয়ে/ আঁখির সুধা পিয়ে হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব- এ যেন ‘আঁখি না তিরপিত ভেল... হিয়ে হিয়ে রাখলু/ তব হিয় জুড়ন না গেল’-এর চির-অতৃপ্তির পরের স্তর- কে বলে, শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান?    

 আঁধারে মিশে গেছে আর সব। যে আঁধার সবকিছুকে মিশিয়ে নেয়, নিজের বিশাল অস্তিত্বে আত্মস্থ করে নেয় ‘আর সব’, সে আঁধার তো নেতিবাচক নয়, সে আঁধার ‘আমি’র গভীরে গিয়ে ‘আমা’কে খুঁজে পাবার, ‘তোমা’র মধ্য দিয়ে। তাতে যদি আমার মনের উপর থেকে নেমে যায় এ জটিল পারিপার্শ্বিকতার, নানান দাবি নিয়ে গুরু হয়ে ওঠা ভার, ‘তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার’! জগতে কারও ক্ষতি না করে যদি আমি নিজের মধ্যে থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে পারি এমন বরষার দিনে, তাতে কিছু কি আসে যায়? মনে পড়ে কবি শঙ্খ ঘোষের বিশ্লেষণ(যদিও প্রসঙ্গ আলাদা)- “ধর্ম আর ভালবাসা এই যে চরিতার্থতা চায়, ভেঙ্গে দিতে চায় নিজের আবরণ, সেইখানেই তো নিয়ে যেতে চায় গান, যে গানের বিষয়ে বলা হয়েছিল ‘চিরকালটাই আসে সামনে, ক্ষুদ্র কালটা যায় তুচ্ছ হয়ে।’” (‘এ আমির আবরণ’) 

এতখানি ভাবতে ভাবতে, শিল্পী ধরে ফেলেন শেষ স্তবক-
‘ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায়
বিজুলী থেকে থেকে চমকায়
যে কথা এ জীবনে
রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়...

মন্দ্র-মধ্য হয়ে তারসপ্তকে, আবার মন্দ্রসপ্তকে – এক-একটা বিমূর্ত শ্বাস- বিরাট কোন সত্যের ভার বয়ে নামতে থাকে গলিত সোনার মত। যেন পূজা পর্যায়ের গান, নিভৃত প্রাণের দেবতার কাছে আর্তি। ঘরোয়া আসরে সামনে বসে থাকা শ্রোতার ভেতরটা ধুয়ে যেতে থাকে আস্তে আস্তে। অনেক না বলা, না বোঝা কথার ভার নিয়ে।
গান শেষ করে শিল্পী বলেন- “বৃষ্টি বোধহয় থেমে গেছে।”

Powered by Froala Editor