পর্ব-৩
শ্রাবণের মধ্যে এক ধরনের পাগলামি আছে। সে ভেজায়, হাসায়, কাঁদায়, উদাস করে, সুর জাগায়, সুর ভোলায়। কবি নিজেই অনুযোগের সুরে বলেছেন নির্মলকুমারী মহলানবিশকে, “ওই ‘শ্রাবণ বরিষণ পার হয়ে’ গানটা স্পষ্ট মনে আছে বেহাগে সুর বসিয়েছি, আর শুনি মেয়েরা গাইছে মল্লারে। আমি আপত্তি করাতে বলল- বাঃ, পরশু দিন দিনদার ক্লাসে শিখেছি। দিনদা ভুল সুর শিখিয়েছেন এ হতেই পারে না, আপনি ভুলে গেছেন। হায় রে আমার শনিগ্রহ! গানে যে হতভাগ্য সুর বসিয়েছে তার মনে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু ওরা সে কথা কিছুতেই মানলে না, কারণ দিনদার কাছে যে শিখেছে। আমার কবির খেয়ালের চেয়ে দিনদার উপর অনেক বেশি ভরসা।”(নির্মলকুমারী মহলানবিশ ‘কবির সঙ্গে দাক্ষিনাত্যে’) স্বরবিতানে অবশ্য দুরকম স্বরলিপিই পাওয়া যায়। সুর নিয়ে, স্বরের ব্যাকরণের চোখ রাঙ্গানির ভয়ে ভুগতে হয়েছিল স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেই। এক এক সময় অসহায়ের মত বলতে শোনা গেছে তাঁকে- “গানটা তো আমারই, দিলুমই না হয় একটা নতুন সুর।” তাঁর কোনো কোনো গানের বিকল্প সুর নিয়ে কৌতূহল বা আলোচনারও শেষ নেই। এই “শ্রাবণ বরিষণ পার হয়ে” গানটি প্রসঙ্গেই আরও দেখি, “রবীন্দ্রনাথ এখানে যে মল্লার সুরের কথা বলেছেন তা আসলে দেশ রাগ। রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলায় দেশ বা দেশমল্লারকে মল্লার বলার রেওয়াজ ছিল।” লিখছেন সুধীর চন্দ(রবীন্দ্রসঙ্গীতঃ সুরান্তর, রূপান্তর)।
দেশমল্লার হোক বা বেহাগ, সে তো সুরের মূল আধার রাগরূপ মাত্র। গানটার কি হল তাহলে? গানটি গেয়েছেন একাধিক শিল্পী, কেউ প্রচলিত স্বরলিপি মেনে, কেউ বা বিকল্প স্বরলিপি অনুসারে। এ গানের পরিবেশনে অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে আছে সুচিত্রা মিত্র বা পূর্বা দামের মত স্বনামধন্য শিল্পীদের রেকর্ডিং।
তবু ভাবতে ইচ্ছে করে, ঘনঘোর বর্ষার এক দিন - মেঘ করেছে কলকাতার আকাশ জুড়ে, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামব নামব করছে, দমকা হাওয়ায় ভর করে গানটা গিয়ে আশ্রয় নিল সেই মানুষটির কণ্ঠে, যার কাছে রবীন্দ্রনাথের গান এক স্পর্ধিত উচ্চারণের, কখনও বা মেঘলা অভিমানের অবলম্বন। ‘রয়ে রয়ে রয়ে’ যখন তিনি উচ্চারণ করেন, মনে হয় সত্যি ভেজা বাতাস এমনভাবেই এসে লাগে গায়ে, একটানা নয়, থেমে থেমে। মেঘলা দিন, বৃষ্টির ঝাপটা তাঁর বড় প্রিয়। ১৭৪ই, রাসবিহারী অ্যাভেনিউর মাথায় মেঘ জমলেই তিনি ছাত্রছাত্রীদের ডেকে নিয়ে বসেন গলির মুখটায়। থাকেন গান শিখতে আসা তাঁর ভাগ্নিরাও। সঙ্গে একটা বড় ছাতা। বৃষ্টি নামলেও ভ্রুক্ষেপ নেই, ভিজতে ভিজতে গেয়ে চলেন, ‘শ্রাবণ মেঘে ওই আধেক দুয়ার খোলা’, ‘আজি বরিষণ মুখরিত শ্রাবণরাতি’, ‘শ্রাবণের পবনে আকুল বিষণ্ণ সন্ধ্যায়’, ‘শ্রাবণ তুমি বাতাসে কার আভাস পেলে’...
তিনি দেবব্রত বিশ্বাস, সবাই চেনে জর্জ নামেই বেশি। কারও কাছে জর্জদা, কারও কাছে আরও আদরের ডাকে ‘কাকা’। তাঁকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই, তাই জীবৎকালেই তিনি কিংবদন্তি। তাঁর গান নিয়ে একদিকে যেমন অপার বিস্ময়ের আকাশ, অন্যদিকে তেমনি বিরূপ সমালোচনার কাঁটা। ‘রুদ্ধসঙ্গীত’-এর সংবেদী পাঠকমাত্রেই সেই ব্যতিক্রমী শিল্পীর যন্ত্রণা, অভিমান আর নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার করুণ ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত। এই অভিমানকে সঙ্গী করেছিলেন বলেই কি মেঘলা গান, শ্রাবণের গান এক আলাদা মাত্রা পেত তাঁর গলায়? গানপাগল সাধারণ বাঙালির কাছে অবশ্য ‘আকাশ ভরা সূর্য তারা’, ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভু’, ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ আর ‘যে রাতে মোর দুয়ারগুলি’র সঙ্গেই তাঁর নাম বিশেষ ভাবে জড়িয়ে, তবু মনে হয় রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান, শ্রাবণের গান বোধহয় সমসাময়িক অন্যান্য বিশিষ্ট শিল্পীদের তুলনায় অনেক বেশি সংখ্যায় গেয়ে গেছেন তিনিই – কোম্পানির ছাপ মারা রেকর্ড অথবা ঘরে বসে নিজের খেয়ালে লাইভ রেকর্ডিং, সব মিলিয়ে। রবীন্দ্রনাথের গানকে ‘সেরিব্রাল’ বলতেন যিনি, তাঁর এই নির্বাচনের পেছনে কি কোন সচেতন ভাবনা কাজ করেনি, প্রতিফলন ঘটেনি তাঁর ব্যক্তিত্বের একটি বিশেষ দিকের?
আরও পড়ুন
“আমি শ্রাবণ আকাশে ওই দিয়েছি পাতি...”
রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গেলে ভাবটা আগে বুঝতে হয়, বলতেন তিনি। যেমন ‘আজি বরিষণ মুখরিত শ্রাবণরাতি’। মুখরিত শব্দটির ‘ত’ অধিকাংশ শিল্পীই উচ্চারণ করেন ‘মুখরি’ অংশটির সঙ্গে একযোগে। জর্জ ‘ত’ উচ্চারণ করেন যেন একটু আলাদাভাবে, বেশি মাত্রায় ঝোঁক দিয়ে – তাতে মনে হয় বৃষ্টির ধারায় শ্রাবণ রাতের মুখর হয়ে ওঠা একটা বিশেষ ঘটনা, আবার এই মুখরতার বিপ্রতীপে রয়েছে একাকিত্ব- ‘স্মৃতি বেদনার মালা একেলা গাঁথি’। প্রকৃতি যখন মুখর, একলা ঘরে বসে থাকা স্মৃতির টুকরো জুড়ে জুড়ে মালা গেঁথে চলা মানুষটি তখন একা। ‘গাঁথি’ শব্দে এসে যেন আর টানতে পারছেন না শিল্পী- তাঁর শ্বাসকষ্টজনিত অসুস্থতা ছিল, জানা কথা। কিন্তু সেই অস্বস্তিকে কেমন অলঙ্কার করে নিয়েছেন তিনি- স্মৃতি-বেদনার মালা গাঁথতে গাঁথতে ক্লান্ত হয়ে পড়ার অভিব্যক্তি হিসেবে সুন্দর মানিয়ে যায় প্রায় অস্ফুট, মৃদু হয়ে পড়া শ্বাস-সহ গেয়ে ওঠা ‘গাঁথি’। ‘আজি কোন ভুলে ভুলি/আঁধার ঘরেতে রাখি দুয়ার খুলি’ হয়ে ওঠে আশার চেয়ে অনেক বেশি এক ‘ভুল’ ভাবনার সওয়ার- কেউ হয়ত আসবে না, তবু বৃথা আশ্বাসে এই রজনী যাপন। হয়ত সে আসবে না, তবু কবির মনে হয় ধারাজলে সুর লাগল, নীপবনে জাগল পুলক। তার আসার আশায় ধারাজলে যে নাটকীয়তার সুর লাগে, তার দায়িত্ব নিতে হয় তাই শিল্পীকেই, একাকিত্বের সান্ত্বনা খুঁজতে হয় নিজেরই সত্তায়- সে আদৌ আসবে কিনা, কে জানে! দীর্ঘশ্বাসে ভরা স্থায়ী থেকে ভুলের খেলায় বিচলিত অন্তরা হয়ে সঞ্চারী অংশে এসে ধরা পড়ে এক নতুন গতি, যা একাকিত্ব থেকে উত্তরণ তথা পরিণতি খোঁজে আত্মনির্ভরতায় ঋদ্ধ বিশ্বাসে- সে আসছে, বাইরে না হোক, আমারই মনে। যদি নাও আসে, তবু পেতে রাখব মিলন-আসন – পেতে রাখার অধিকার তো একান্তই আমার। গানের সঙ্গে সঙ্গে এই বিশ্লেষণী বোধও শ্রোতার মননে ছড়িয়ে দেন জর্জ।
এর পাশাপাশি ‘শ্রাবণের পবনে আকুল বিষণ্ণ সন্ধ্যায়’ গানটির কথাও ধরা যাক। বিষণ্ণতা আর ব্যাকুলতার ভার যেন ছড়িয়ে আছে ধীরলয়ে গাওয়া, শ্বাস-বিরতির বিধুর-গম্ভীর অভিব্যক্তি-সহ নিবেদিত এ গানের প্রতিটি লাইনে। আবার ‘ওগো আমার শ্রাবণ মেঘের খেয়াতরীর মাঝি’ গানটি শুনলে পাওয়া যায় একেবারে অন্যরকম মেজাজ। এখানেও স্মৃতি আছে, বেদনা আছে কিন্তু স্মৃতি-বেদনার ভার নেই। শ্রাবণ মেঘের খেয়া যেন বাধাহীন, চলেছে অসীম আকাশে পাল তুলে, শিল্পীর মন শরিক হতে চায় সেই অবাধ নিসর্গযাত্রার অশ্রুভরা ব্যপ্তির। এই মেঘের খেয়ার মাঝি জানে তার ঠিকানা- যে ছিল তাঁর জীবনের ভোরবেলাকার খেলার সাথী। তাই মেঘের খেয়ায় সেই সাথীর উদ্দেশে পাড়ি দেওয়া- জীব নের সব ভার, সব বোঝা থাকুক পিছনে পড়ে।
আরও পড়ুন
“আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান…”
আরও আছে। ‘আষাঢ় কোথা হতে আজ’, ‘বহু যুগের ওপার হতে’, ‘আজ শ্রাবণের আমন্ত্রণে’, ‘পুব সাগরের পার হতে’, ‘আমার দিন ফুরাল ব্যাকুল বাদল সাঁঝে, ‘রিমিকি ঝিমিকি ঝরে ভাদরের ধারা’- আষাঢ়-শ্রাবণের গান, শ্রাবণ শেষেও বৃষ্টি শেষ না হওয়া ভাদরের গান, মেঘ-বৃষ্টি ঝড়ের নানা রূপের গান বারে বারে গেয়েছেন তিনি এক অদ্ভুত মোহ ছড়িয়ে। তবে শ্রাবণের সঙ্গে তাঁর গায়ক সত্তার আত্মীয়তা অতি গভীর। সে সব গান সঙ্গীতপ্রিয় বাঙালির সম্পদ হয়ে আছে।
শ্রাবণের বিদায়গান লিখে নিজেই খুশি হতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। একবার বর্ষামঙ্গলের অনুষ্ঠান শেষে শৈলজারঞ্জন মজুমদার তাঁর সামনে এসে দাঁড়াতেই কবি অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, “গোড়া থেকেই মনটা খারাপ করে দিলে। কি বিশ্রী গান, হায় হায়, যায় যায় দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করে দিলে।” শৈলজারঞ্জন অবাক, কবির নিজের লেখা গান যে তাঁর ভালো লাগবে না, তিনি বুঝবেন কেমন করে? ‘শ্রাবণ তুমি বাতাসে কার আভাস পেলে’ দিয়ে শুরু হয়েছিল সেবারের অনুষ্ঠান, ছেলেমেয়েরা চেয়েছিল বলেই। সেকথা জানাতে একটু থেমে রবীন্দ্রনাথ আবার বলেন, ‘না না, ভাল হয়েছে, কিছু মনে কোর না।”(যাত্রাপথের আনন্দগান) ভালবাসার শ্রাবণ, কবির ধ্যানের ধন শ্রাবণ চলে যাচ্ছে বলেই কি মন কেমন করে উঠেছিল তাঁর? অবশ্য গানের শেষে আছে আশার বাণী, শরতের আলো এসে ধুয়ে দেবে শ্রাবণের বিদায় ব্যথা। এ গান জর্জ গেয়েছেন একেবারে নিজের ধরনে। গানের বাণীতেই ধরা পড়ে কথোপকথনের ভঙ্গিমা, নাটকীয় অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য আদর্শ। বিশেষ করে ‘হায় হায়’ আর ‘যায় যায়’ গাওয়ার সময় মনে হয় কবির শ্রাবণ-বিদায়ের ব্যথা একাকার হয়ে গেছে শিল্পীর অনুভূতির সঙ্গে। তাঁর চিরবিদায়ের দিনটিও ছিল শ্রাবণ বিদায়ের পরের মাসেই, ভাদরের ধারায় ভেসে। ইংরাজি তারিখ ১৮ আগস্ট। ১৯৮০ সালের সেই দিনটিতেও কলকাতা ভেসেছিল বৃষ্টিতে।
আরও পড়ুন
‘কলোকী পুলোকী সিংগিল মেলালিং’ – স্বল্প স্কুলজীবনে এমনই আবৃত্তি শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
তার কয়েকমাস আগে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে, কিংশুক গোষ্ঠীর সহযোগিতায় আয়োজিত তাঁর সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে- বহুদিন অন্তরালে থাকার পর যা ছিল জনসমক্ষে তাঁর শেষ অনুষ্ঠান- যে কটি গান গেয়েছিলেন জর্জ বিশ্বাস, তার মধ্যে কিন্তু তাঁর প্রিয় বর্ষার গান ছিল না একটিও। বরং ‘দিনের তাপে রৌদ্রজ্বালায়’ গাইতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য গলা ধরে গিয়েছিল তাঁর। হয়ত নিছকই সমাপতন, কিন্তু এর মধ্যে কি পূজার থালায় শুকিয়ে আসা মালার ইঙ্গিত ছিল কোনো? হেমন্ত অবশ্য ‘কাকা’র সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন ‘এমন দিনে তারে বলা যায়’। দুই শিল্পীর কণ্ঠেই গানটি অমর হয়ে আছে রেকর্ডিং-এ।
জর্জ বিশ্বাসের প্রয়াণের অনেকদিন পরে- একবার রাস্তার ক্রসিং-এ দাঁড়িয়েছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাড়ি। অদূরে কোথাও মাইকে তখন বাজছিল ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’। শুনে একটু উদাস হয়ে পড়লেন হেমন্ত। ‘এ গানটা কাকার গলাতেই মানায়’ বলে তিনি নিজেও গাইতে শুরু করলেন। গাড়িতে তখন সঙ্গী ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ চিকিৎসক, ডাঃ প্রবীরকুমার দত্ত। সে এক বিরল অভিজ্ঞতা- বাইরে মাইকে শোনা যাচ্ছে প্রয়াত জর্জ বিশ্বাসের কণ্ঠ, আর গাড়ির মধ্যে বসে গাইছেন হেমন্ত, ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’। গানটি এর আগে কোনো এক ঘরোয়া আসরেও গেয়েছিলেন হেমন্ত, তবে অনুষ্ঠানে বা রেকর্ডে গাইতেন না। এ গানে শ্রাবণ নেই, তবে মেঘ আছে। মেঘের কত রকম রূপই তো হয়। কখনও সে মেঘ অভিমানী, বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটায় জমে থাকা কান্না ঝরিয়ে দেবার জন্য আকুল, কখনও আবার আকাশ জুড়ে তার স্নিগ্ধ, সজল ব্যপ্তিতে সব ক্লান্তি, বেদনা, অবমাননা, অস্তিত্বের যন্ত্রণা মুছিয়ে দিতে পারার মত এক নিবিড়, বিরাট ছায়া।
আরও পড়ুন
অনশন শুরু করলেন জেলবন্দি নজরুল, প্রত্যাহারের অনুরোধ জানিয়ে টেলিগ্রাম রবীন্দ্রনাথের
কৃতজ্ঞতাঃ ডাঃ প্রবীর কুমার দত্ত, শ্রীশঙ্কর দাস
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
প্ল্যানচেটে রবীন্দ্রনাথকে ডাকলেন প্রবোধকুমার, আবৃত্তি করে শোনালেন কবিতাও!