এই গ্রামের বাসিন্দা মাত্র একজন!

প্রতি বছর ভোট হয় এই গ্রামে। যার মাধ্যমে নির্বাচিত হন একজন প্রধান। তিনিই সারা বছর দেখভাল করেন গ্রামবাসীদের সুবিধা-অসুবিধা। যে কোনো বিষয়ে অভিযোগ জানানো হয় তাঁর কাছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই ‘সকল কাজের কাজি’ আসলে একজনই। তিনিই প্রধান, তিনিই ভোটদাতা, তিনিই নিজের মুশকিল আসান। কারণ আমেরিকার মোনোয়ি (Monowi) গ্রামের জনসংখ্যা মাত্র এক! ৮৬ বছর বয়সী এই ভদ্রমহিলার নাম এলসি এইলার (Elsie Eiler)।

এমনিতে আকারে খুব বেশি বড়ো নয় নেব্রাস্কা প্রদেশের এই গ্রামটি। মিসৌরি আর নিওব্রারা নদী বয়ে গেছে দু-পাশ দিয়ে। একদিকে রয়েছে নেব্রাস্কা, অন্যদিকে দক্ষিণ ডাকোটা। লম্বা রাস্তায় সোনালি ধানের মাথা নাড়ানো দেখতে দেখতে অনায়াসে পৌঁছে যাওয়া যায় এখানে। মোনোয়ির একমাত্র পানশালাতে গলাও ভিজিয়ে নেওয়া যায়। ব্যবস্থা আছে মুখরোচক কিছু খাবারের। কিংবা গ্রামের লাইব্রেরির পাঁচ হাজার বইয়ের মধ্যে কেটে যেতে পারে গোটা দিন। অবশ্য এই সব কিছুরই দায়িত্ব সেই একজনের উপরেই। নিজেকে লাইসেন্স দেন তিনি নিজেই। গ্রামের চার্চের জন্য বরাদ্দ করতে হয় অর্থ। ফলে এই অসীম একাকিত্বের মধ্যেও তাঁর দায়িত্বের শেষ নেই। 

কিন্তু কীভাবে হল এই অবস্থা? ১৯০২ সালে একটি কোম্পানি যখন এই অঞ্চলে রেললাইন প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করে, তখনই পত্তন হয় গ্রামটির। সেই অনুযায়ী বানানো হয় ঘরবাড়ি, পোস্ট অফিস। নেব্রাস্কার বিখ্যাত ফুল মোনোয়ি-র নাম অনুসারে রাখা হয় গ্রামের নাম। ১৯৩০-এর মধ্যে তার জনসংখ্যা পৌঁছোয় ১৩২-এ। আমেরিকার আদমশুমারির তথ্য অনুযায়ী, গত একশো কুড়ি বছরের ইতিহাসে এটাই এই গ্রামের সর্বোচ্চ জনসংখ্যা। অবশ্য তারপর থেকেই শুরু হয় নিষ্ক্রমণ। খুব উর্বর নয় এই অঞ্চলের জমি, ফলে চাষাবাসের সমস্ত প্রচেষ্টা আক্ষরিক অর্থেই মাঠে মারা পড়ে। জীবিকার উদ্দেশ্যে তারা ছড়িয়ে পড়েন আশেপাশের বড়ো শহরগুলিতে। কুড়ি বছরের মধ্যে জনসংখ্যা এসে দাঁড়ায় ৬৭-তে। আর গত শতকের শেষ দশকে জনসংখ্যা মাত্র ৬। বন্ধ করে দিতে হয় রেল পরিষেবা, পোস্ট অফিস।

২০০০ সালের জনগণনায় এই গ্রামে মেলে মাত্র দুজন মানুষের সন্ধান। এলসি ও তাঁর স্বামী রুডি। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পানশালাটা ছিল তাদের জীবন-জীবিকা। রুডির শখ ছিল বই জমানো। স্বপ্ন ছিল গ্রামের মানুষদের জন্য এক বিরাট লাইব্রেরি স্থাপন করবেন। কিন্তু কেউই আর রইল না সেই লাইব্রেরিতে বই পড়ার জন্য। ২০০৪ সালে মারা যান রুডি। তখন থেকেই একার সংগ্রাম চলছে এলসির। স্বামীর শেষ স্বপ্নকে বাস্তব করে প্রতিষ্ঠা করেছেন লাইব্রেরি। মোনোয়ি-তে যারা বেড়াতে আসেন, তারা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে পড়তে পারেন বই কিংবা নিয়ে যেতে পারেন ধার হিসেবে। লাইব্রেরির পাশাপাশি গ্রামের জন্য বরাদ্দ বাজেটের হিসেব-নিকেশ দিতে হয় তাঁকে। নিজেই নিজেকে জমা করেন ট্যাক্স। আমেরিকার সাম্প্রতিক গণনায় কিন্তু এই গ্রামের জনসংখ্যা বলছে দুই। কিন্তু দ্বিতীয় ব্যক্তিটি যে কে, তার হদিশ নেই কোনোখানেই।

আরও পড়ুন
মুণ্ড শিকারের গ্রাম! ভারত-মায়ানমার দু’দেশেরই নাগরিক এই গ্রামের বাসিন্দারা

ফলে একার ‘রাজত্ব’ এলসির। পর্যটকদের মাধ্যমে পানশালা থেকে সামান্য আয়ই তাঁর একমাত্র সম্বল। ডায়েরিতে সংরক্ষণ করে রাখেন তাদের স্বাক্ষর। হয়তো পর্যটকদের ভিড়ে কিছুটা কমেছে নিঃসঙ্গতা। কখনও কি ইচ্ছা করেনি তাঁর এখান থেকে চলে যেতে? মানুষের সঙ্গ পেতে? ভিড়ের মধ্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে? অস্বীকার করেননি তিনি। কিন্তু একটা মায়া পড়ে গেছে এতদিনের গ্রামটির উপর। কত স্মৃতি জড়িয়ে এখানে। চলে যাওয়াই যায়, আর তো উপায় থাকবে না ফিরে আসার। এই শূন্য রাস্তা, পুরনো ফাঁকা বাড়ি ফেটে বেরিয়ে আসা গাছের শিকড়, রোজ ধুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করা লাইব্রেরির স্বাদ তিনি তো আর পাবেন না কোথাও। না থাক। এই বয়সে আর প্রয়োজন নেই ‘উদ্বাস্তু’ হওয়ার। এভাবেই রয়ে গেলেন এলসি। এভাবেই মোনোয়িকে আগলে রেখে বেঁচে আছেন তিনি।

আরও পড়ুন
মহারাষ্ট্রের যে গ্রামে বিষধর সাপেরাও মানুষের ‘দোস্ত’

Powered by Froala Editor