১৯৯৮, বিশ্বকাপ ফাইনাল। আমার তখন তিন। স্মৃতির মণিকোঠায় যা আছে সবই শোনা কথা বাবা, মা র কাছে। ব্রাজিল, ফ্রান্স ফাইনাল চলছে। তখন আমাদের বাড়িতে পাড়ার প্রায় সবাই আসত, খেলা দেখতে। একসঙ্গে ত্রিশ জন মিলে খেলা দেখা। গোটা বাড়ির ব্রাজিল সমর্থনের বিরুদ্ধে শুধু একা ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আমার কাকা। মারাদোনা অন্ধ হওয়ায় তিনি চিরকাল ব্রাজিল অ্যান্টি। তো সবাই বিপক্ষে দেখে তিনি আমাকে নিজের দলে ভিড়িয়ে নিলেন। তারপর, বাবার কাছে শোনা সেদিন কাকা ছাড়া আর কারোর মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরোয়নি। যার মূলে ছিলেন একজন মাথা কামানো তরুণ। তার মাথা থেকে আছড়ে পড়া দুটো হেডে ব্রাজিলের জাল কেঁপে উঠতেই ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল বাড়ির সকলের স্বপ্ন। প্রথম বারের জন্য বিশ্বকাপ পেয়েছিলো ফরাসি দল। ভালোবাসাটা হয়তো সেদিনই তৈরি হয়ে গিয়েছিল খেলাটার প্রতি। তাই এখনও অবচেতন মনে ভাবতে বসলে মনে পড়ে সেসব। সেদিন ফুটবল প্রেমের যে চারা জন্ম নিয়েছিল এক বছর তিনের শিশুর মধ্যে, তা আজ বৃক্ষ হয়ে বয়ে চলেছে আমার গোটা শরীরে।
এরপর ধীরে ধীরে বয়স বাড়ল। প্রাইমারি পেরিয়ে হাইস্কুল। বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, মেয়ে দেখা, পড়াশোনা এবং ফুটবল। ততদিনে বাবার সৌজন্যে যাতায়াত শুরু হয়েছে কোলকাতা ময়দানে। বিদেশি ঘরানায় মেতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সৌন্দর্য সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল হওয়ার অমোঘ আকর্ষণ আমায় আরও বেশি টানতে শুরু করেছে ময়দানের দিকে। আর বাবার মতোই আমার ছোট্ট মস্তিষ্কে তখন সব সময় ঘোরপাক খাচ্ছে ছ' অক্ষরের একটা নাম। ক্লাস ফাইভ। বুঝেও উঠিনি ঠিকঠাক সব নিয়ম। গরমের ছুটিতে বাবার কাছে গল্প শুনছি চুণী, সুব্রত, প্রসূনের। দুপুরবেলা খেতে খেতে দাদু নিয়ে যাচ্ছে গোষ্ঠ পাল, শৈলেন মান্নার দেশে। আস্তে আস্তে সেই ছোট্ট ছেলেটা প্রবেশ করছে এক স্বপ্নের যাত্রাপথে। তার সামনে খুলে যাচ্ছে ভালোবাসার এক নতুন দরজা। এরপর একটু একটু করে বয়সের পাল্লা ভারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগ্রহ ও ভালোবাসাও সমানুপাতে বাড়তে লাগল। সবুজ মেরুন জার্সি। পতাকা, আবীর। নিয়ম করে খেলা দেখা। আলোচনা। তর্ক৷ সব যেন কোনো এক অদৃশ্য জাদুবলে ধীরে ধীরে জীবনের অংশ হতে শুরু করল।
সেবার অসাধারণ টিম। হট সিটে করিম স্যার। সুরকুমার। দীপক মণ্ডল। জেমস সিং। সামনে বিষাক্ত ব্যা-ভা জুটি। তবুও শেষ রক্ষা হলো না। রানার্স হওয়ার দিন পাগলের মতো কাঁদার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে বসেছিল মা। সেটা ছাড়া সেদিনের সব স্মৃতি যেন কোথাও হারিয়ে গেছে আমার মধ্যে থেকে। এরপর ব্যারেটোর বিদায়। ভবানীপুর। যাইনি মাঠে। দু চোখে থিকথিক করছে জল। এক সব হারিয়ে ফেলা ছেলের মতো টিভির পর্দায় একদৃষ্টে তাকিয়েছিলাম ঐ অবয়বটার দিকে। বছর বছর ধরে আনন্দের উৎস হয়ে ওঠা মানুষটার এই অচেনা রূপ দেখে থমকে গিয়েছিলাম রীতিমতো। দিদাকে হারানোর বহু আগে উপলব্ধি করেছিলাম স্বজন বিয়োগের প্রকৃত বেদনা।
এরপর সময় এগিয়ে গেছে নিজের মতো। আট বছর ট্রফিলেস। ডার্বিতে বার বার হার। কর্মকর্তাদের অপেশাদারিত্ব, ভালোবাসার আকাশে ঘনিয়ে এনেছে অন্ধকার। ৯ ডিসেম্বর। ডার্বি। ঝামেলা। রক্তপাত। ওডাফা। লাল কার্ড। চোখের সামনে রক্তাক্ত রহিম নবি। অসম্পূর্ণ ম্যাচ জন্ম দিয়ে গেছে এক তীব্র উদাসীনতার৷ রাজনীতির ঘেরাটোপে সন্তোষ কাশ্যপ, স্টিভ ডার্বি, ড্যানিয়েল জেলেনিদের আগমন যেন আমার আত্মার পবিত্রতায় বার বার নৃশংসভাবে ছুরি চালিয়েছে। এরই মধ্যে জন্ম নিয়েছে ISL নামক সংক্রমক। প্রথম প্রথম তার নেশায় বুঁদ হতে ইচ্ছে করেলও তার প্রকৃত রূপ সব স্বপ্নের আহুতি হয়ে ভেসে উঠেছে চোখের সামনে। তবুও ভালোবাসা মরেনি। হাজারবার চোখ ঘুরিয়ে নেওয়ার চেষ্টাও আবার মাঠে ফিরিয়ে এনেছে সামান্য আলোর সন্ধানে।
আরও পড়ুন
মোহনবাগানের নামের আগে জুড়ল 'এটিকে'; অপরিবর্তিত লোগো ও জার্সির রং
এভাবে চলতে চলতেই ২০১৫-র চলে আসা। ডাগ আউটে সঞ্জয় সেন। মাঠে সোনি। সোনি নর্ডি। নতুন বিদেশি। তবুও কেমন যেন চেনা। কোথাও যেন একটা অদৃশ্য টান। যেমন কয়েক বছর আগে এক ব্রাজিলীয়কে দেখলেও ঝড়ের বেগে বেড়ে যেত অনায়াসে। মাঝমাঠে পিয়ের বোয়া। আমাদের পিবো। চোখে অনেক স্বপ্ন। ডিফেন্সে বুকে আগুন বয়ে বেড়ানো বেলো। সবাই যেন ফুটছে। একটা করে জয় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের কাছে। তবুও শেষ ম্যাচে এসে টান টান উত্তেজনা। এক-শূন্য তখন মৃত্যুর দরজা যেন। সময় শেষের প্রতিটা মুহূর্তে লেপ্টে থাকা আর্তি আমাদের অস্থিরতার সাক্ষী বহন করে যেন ফুরিয়ে আসছিল। তখনই হঠাৎ চিৎকার। বেলো, বেলো চিৎকারে কান ফেটে যাওয়া। বাজি আর রোশনাইয়ে মোড়া কাটানো সেই রাতের সাক্ষী আমরা সব্বাই। এরপর ফেডকাপ। যেন অনেকদিন পর হাওয়া প্রাণ খুলে বইছে। মনের সুখে ভালোবাসায় লেপ্টে নিয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের নৌকা। কিন্তু হঠাৎ আবার সেই অসংগতি। বার বার হার। আই লীগ জয়ী কোচের গায়ে হাত। ছেড়ে চলে গেলেন অপমানে। অর্থের হাতে আবেগের মৃত্যু। সমস্ত খেলোয়াড়দের ভুলতে না পারা বিদায়। প্রাণ দিয়ে দেওয়া খেলোয়াড়দের হাত শূন্য করে দেওয়ার অপদার্থতা।
এসব নিয়েই এগোতে এগোতে ২০১৯। এক স্প্যানিশের পদাপর্ণে হঠাৎই আলো জ্বলে উঠল অন্ধকার ক্লাব তাঁবুতে। বিদেশিদের সঙ্গে বাঙালি ছেলেদের মিশে যাওয়া দেখে আবার অনেকদিন পর খসে পড়ল কয়েকফোঁটা জল। সেই আনন্দাশ্রুকে তরান্বিত করতে মাঝমাঠে কবিতা লিখতে শুরু করলেন আরেক স্প্যানিশ তারকা। এক ভারসাম্যহীন ক্লাব থেকে দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবল শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল একটা দল। যাদের অর্থ ছিল না। আবেগ ছিল। সুবিধা ছিল না, ছিল তাগিদ। পরিকাঠামোর অভাব জন্ম দিয়েছিল অপরিসীম জেদের। স্বপ্নের ফুটবলে আবারও ঘরে উঠে এসেছিল ভারতসেরার শিরোপা। এক মুহূর্তে সব কেমন যেন হারিয়ে গেল হঠাৎই। সমস্ত আবেগ, রাগ, হতাশা, তাগিদ, জেদ, লড়াই, স্বপ্ন হাঁটমুড়ে বসে পড়ল অর্থের অদমনীয় শক্তির সামনে। আত্মসমর্পণ। আর জন্ম হল আজীবন এক অগ্রহণীয় সত্যির!
আরও পড়ুন
হোলির দিনেই ভারতজয়, আইলিগে ফের বাজিমাত মোহনবাগানের
যখন কিচ্ছু ছিলো না, ট্রফির অভাবে বছরের পর বছর চাতকের মতো বসে থাকার সঙ্গী ছিল একচিলতে প্রত্যাশা। এত সবের পরেও একটা বদঅভ্যেস কিছুতেই ছেড়ে যেত না আমাদের। সে ভালোবাসা হয়ে রক্তে বইতে শুরু করত। তাই একটা নাম শুনলেই বুকটা কেঁপে উঠত। ঐ নামে পাশে কেউ চিৎকার করলেই সারা গায়ে একটা বিদ্যুতের স্ফুরণ বয়ে যেত। মনের অতল তলে তলিয়ে যাওয়া আগ্রহটা ডুব সাঁতার দিতে দিতে হঠাৎই যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পড়ত আবার। ব্যারোটোর ডার্বি জেতানো গোল। প্রতিটা বিষাক্ত পাস ভেসে উঠত চোখের সামনে। দাদাগিরিতে বিখ্যাত দম্পত্তিকে ঐ নামটা নিতে শুনে যে অনুভূতির জন্ম হত, তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর শব্দের অভাব দেখা দিত মস্তিষ্কের অভিধানে। প্রতিটা নিরাশাগ্রস্ত রাতে আবারও স্বপ্ন দেখাত ১৯১১-র সেই দিনটা। জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দিত বারবার। স্পাইকের বিরুদ্ধে খালি পায়ের জয় বুঝিয়ে দিত পা মাটিতে রেখেই জিততে হয়, সামান্য উড়তে শুরু করলেই পতনের হাত থেকে রেহাই নেই। বুঝতে শেখাত জীবনের খেলায় লড়ে যাওয়াটাই আসল কথা। জানতে শেখাত ঐক্য আমাদের সাফল্যের কোন সীমায় নিয়ে যেতে পারে। বিশ্বাস করতে শেখাত নিজেকে, অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারার অপরিসীম ক্ষমতায়।
তাই ভারতীয় ফুটবল থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা দুটো চোখ, বিদেশি ফুটবল নিয়ে মজে থাকা সত্ত্বেও সপ্তাহে দুদিন মাঠে যেতে ভুলত না কোনোবার। অসংখ্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও ম্যাচের খবর দেখে নিত অনায়াসে। আর শেষে সব কিছু হারিয়ে যেত কোনো এক গভীর সমুদ্রে। আর জীবনের সব ভালোবাসা, সব আবেগ, সব যন্ত্রণা, সব আনন্দ, সব কষ্ট, প্রেমের সেই ছটা অক্ষরে এসে মিলিত হত, মো হ ন বা গা ন। আজকের পর থেকে তা আর কোনোদিন সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে আমি আর নিশ্চিত হতে পারছি না!
আরও পড়ুন
এটিকে-মোহনবাগান, এটি কি মোহনবাগান?
Powered by Froala Editor