অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখানোর প্রতিশব্দই ‘বিজ্ঞান’। পঞ্চাশ বছর আগেও কি মানুষ চিন্তা করতে পেরেছিল, মাতৃজঠরের বাইরে ডিম্বাণু এবং শুক্রাণুর মিলন সম্ভব? বছর চল্লিশ আগে টেস্টটিউব বেবি ভেঙে ফেলেছিল সেই ধারণা। ঠিক তেমনভাবেই আরও এক বড়ো সাফল্য পেলে চিকিৎসাবিজ্ঞান। এবার সম্পূর্ণ কৃত্রিম উপায়েই বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে বানিয়ে ফেললেন মানবভ্রুণ। ইতিহাসে এই প্রথমবারের জন্য ঘটল এমন অবিস্মরণীয় ঘটনা।
কৃত্রিম উপায়ে ভ্রুণ তৈরির এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে দুটি পৃথক গবেষকদল। দুটি দলই ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে গবেষণাগারে তৈরি করেছে মানবভ্রুণ। গত ১৭ মার্চ ‘নেচার সায়েন্স’ বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে দুটি গবেষণাপত্রই।
শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর মিলনের ৬-৮ দিন পরে গঠিত হয় মানবভ্রুণ। শ’খানেক কোষ মিলিয়েই মূলত তৈরি হয় এই গোলকাকার কোষমণ্ডলী। যাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় ‘ব্লাস্টোসিস্ট’। ১ মিলিমিটারেরও কম ব্যাসের এই ছোট্ট কোষমণ্ডলী থেকেই ধীরে ধীরে বিকশিত হয় গোটা ভ্রুণ এবং মানবশিশুর সমস্ত অঙ্গ।
তবে কৃত্রিমভাবে এই ব্লাস্টোসিস্ট প্রস্তুতিতে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণু ব্যবহার করা হয়নি। তা প্রস্তুত করা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন পদ্ধতিতে। একটি গবেষক দল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ত্বকের কোষ নিয়ে, তাদের জিনগতভাবে পরিবর্তন করে ব্যবহার করেছিলেন ৩ডি স্ক্যাফোর্ডে। সেভাবেই তৈরি হয়েছিল মানবভ্রুণের প্রথম অধ্যায় ব্লাস্টোসিস্ট। অন্য দলটি মানবদেহের স্টেম সেলের বিশেষ রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্লাস্টোসিস্ট তৈরি করে। তারপর সূক্ষ্ম গোলকের মধ্যে তা প্রতিস্থাপিত করা হয়। বলাবাহুল্য, উভয় ক্ষেত্রেই মানবভ্রুণের সঙ্গে কৃত্রিম এই ব্লাস্টোসিস্টের আচরণ হুবহু মিলে যায়।
আরও পড়ুন
আইনস্টাইনের নামাঙ্কিত মৌল, এই প্রথম তৈরি হল গবেষণাগারে
তবে একটি বিশেষ পর্যায়ের পর এই ব্লাস্টোসিস্ট আর পরিণত হতে পারে না। ইঁদুরের জরায়ুতে কৃত্রিম ব্লাস্টোসিস্ট প্রতিস্থাপন করেও তা পরীক্ষা করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। ফলে আপাতভাবে ভ্রুণহত্যার মতো কোনো ঘটনাই ঘটছে না এক্ষেত্রে। এবং সেই কারণেই পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য কৃত্রিমভাবে তৈরি এই ভ্রুণ ব্যবহার করা যেতে পারে অবাধেই।
আরও পড়ুন
সাহারা অঞ্চলে প্রবাহিত হত অন্তত ৫টি বড়ো নদী, জানাচ্ছে গবেষণা
কিন্তু এর পরেও বাড়তি সতর্কতা নিচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর স্টেম সেল রিসার্চ। ভ্রুণহত্যা তথা মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঝুঁকি নিচ্ছে না সংস্থাটি। আর সেজন্যই বদল আনতে চলেছে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধে। কৃত্রিমভাবে ব্লাস্টোসিস্ট তৈরি করা হলেও যাতে তা ১৪ দিনের বেশি পরিণত করতে না দেওয়া হয়, তার জন্য ইতিমধ্যেই নতুন আইন প্রণয়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি।
আরও পড়ুন
অফুরন্ত শক্তির উৎস হতে পারে ব্ল্যাকহোল, তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ দিল সাম্প্রতিক গবেষণা
তবে বৈশ্বিক বিজ্ঞানীমহল কৃত্রিম ভ্রুণ তৈরির এই পদ্ধতিকে যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসাবেই চিহ্নিত করছেন। কারণ এই কৃত্রিম ভ্রুণের ওপর ভিত্তি করেই আগামীদিনে সমাধান আসতে চলেছে একাধিক সমস্যার। মানবভ্রুণের বিকাশ, বন্ধ্যাত্ব এবং গর্ভাপাত ইত্যাদি সমস্যার কারণগুলি কৃত্রিম ভ্রুণের সাহায্যে সম্পূর্ণ অধ্যায়ন করতে সক্ষম হবেন বিজ্ঞানীরা। ফলে সমাধান খুঁজে পাওয়ার পথও অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাছে…
Powered by Froala Editor