স্পট বয় থেকে বলিউডের সুপারস্টার – বাংলার মিঠুন চক্রবর্তীর উড়ান আজও স্বপ্ন দেখায় অনেককে

সত্তরের দশকের শেষের দিক। বলিউডে তখন অমিতাভ বচ্চন নামের এক দৈত্যের রাজত্ব চলছে। পর্দায় হোক কি বাইরে, ‘গুরু’-কে দেখার জন্য ভক্তদের লাইন লেগে যেত। কত মানুষ যে বচ্চন হতে চাইত, তার ঠিক নেই। বাড়ির দেওয়ালে, আয়নার পেছনে, খাতার ভাঁজে কাটআউট। এই প্রবল ঝড়ের মধ্যেই বলিউডের ময়দানে পা পড়ল এক মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলের। স্বাস্থ্য ভালো, শ্যামলা গায়ের রং। ছেলেটার স্বপ্ন অভিনয় করার। এমন স্বপ্ন নিয়ে তো কত তারা আসে মুম্বাইতে, কত তারা ঝরে যায়। ছেলেটা জানে সেসব। ভেতরে পা রেখে আরও জেনে গেল পরিবেশটাকে। বাধ্য হয়ে করতে হয়েছিল স্পট বয়ের কাজ। অমিতাভ-রেখার ব্যাগ বয়ে নিয়ে বেড়ানো…

ছেলেটা মেনে নিয়েছিল সেসব। একের পর এক ফ্লপ, একের পর এক অপমান। সাধারণ ঘরের ছেলে, কী করে টিকে থাকবে এই দুনিয়ায়! কিন্তু শেষ পর্যন্ত করে দেখাল ছেলেটি। শুটিংয়ের পর যাঁদের ব্যাগ বয়ে বেড়াত, একদিন তাঁদের পাশেই জায়গা পেল ছেলেটি। তারও লম্বা লম্বা কাটআউট লাগানো থাকত দেওয়ালে। দেশ পেরিয়ে বিদেশে ছুটল তাঁর অশ্বমেধের ঘোড়া। কিন্তু গৌরাঙ্গ কখনও ভোলেনি সেইসব দিনের কথা। তবে এই নামে আজ তাঁকে খুব কম জনই চেনে। মিঠুন চক্রবর্তীকে কি এইভাবে থামানো যায়? গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী থেকে মহাগুরু হওয়ার যাত্রার কথা প্রতি পদে মনে করান তিনি। তাঁর দিকে তাকিয়েই এখনও স্বপ্ন দেখে মফস্বলের ছেলেটি…

বিগত কয়েকদিন ধরে একটি শব্দ সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। ‘নেপোটিজম’। বলিউডের বুকে এই পরম্পরাটি তো আজকের নয়। সেই কবে থেকে স্বজনপোষণ চলে এসেছে। শুধু বলিউড কেন, জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখুন; সমস্ত জায়গায় এমন ‘রীতি’ই দেখতে পাবেন। নিজের পরিবারেও এমনটা ঘটে হামেশাই। যতবারই এমনটা ঘটে, কেউ না কেউ এসে সেই ব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত করে এগিয়ে যান। বলিউড কালে কালে এমনই কয়েকজনকে দেখেছে, যাঁদের আক্ষরিক অর্থে কোনো গডফাদার ছিল না। নিজের অভিনয়ের জোরে, লড়াই করে মহান হয়েছেন। অমিতাভ বচ্চন থেকে হালের শাহরুখ খান— সবাই এই লড়াইয়েরই উজ্জ্বল মুখ। আর তাঁদের মাঝখান থেকেই উঠে আসেন আরও একজন— মধ্যবিত্ত লড়াই যার রক্তে লেখা। যার চোখের দিকে তাকিয়ে আরও হাজার ‘গৌরাঙ্গ চক্রবর্তী’ বাঁচার সাহস পায়। মিঠুন চক্রবর্তী সেই সব ‘গৌরাঙ্গ’দেরই প্রতিনিধি।

রসায়নের ছাত্র, সেখান থেকে নকশাল আন্দোলন, তারপর সব ছেড়ে অভিনয়ের নেশায় পুনের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইন্সটিটিউট অফ ইন্ডিয়ায় পাড়ি। ১৯৭৬ সালে প্রথম ছবি, পরিচালকের নাম মৃণাল সেন। ‘মৃগয়া’র কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। প্রথম ছবিতেই জাতীয় পুরস্কার জিতেছিলেন, মিঠুনের অভিনয় প্রশংসা কুড়িয়েছিল সমালোচকদের। তা সত্ত্বেও বলিউডে নিজের জায়গা করতে বিস্তর কাঠ-খড় পোড়াতে হয়েছিল। কারণ, তাঁর কোনো ‘গডফাদার’ নেই। স্পট বয়ের কাজও করতে হয়েছিল। লিড রোল আসেনি বহুদিন, ছোটো ছোটো চরিত্রের মধ্যে দিয়েই তাঁর যাত্রা শুরু। সেই সময় টাকারও অভাব; বাধ্য হয়ে সবরকম কাজ হাসিমুখে করতেন মিঠুন চক্রবর্তী। লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে তিনি যাবেন না, এ যেন নিজের কাছে নিজের প্রতিজ্ঞা।

আরও পড়ুন
‘বাংলার সোনু সুদ’ হিসেবে নয়, নিজগুণেই পরিযায়ী শ্রমিকদের পাশে দেব

১৯৭৮ সাল। মুক্তি পায় ‘মেরা রক্ষক’। বলিউডের ময়দানে মিঠুন চক্রবর্তীর প্রথম সফল কাজ। আস্তে আস্তে হাওয়া বদলের আভাস আসতে থাকে। ‘প্রেম বিবাহ’, ‘ওহ জো হাসিনা’ ‘সুরক্ষা’— দর্শকরা চিনতে শুরু করেন নবাগত এক বাঙালি অভিনেতাকে। তারপর এল আশির দশক। বলিউডে যে সময়কে বলা যেতে পারে ‘মিঠুন দশক’। সেই থেকে শুরু হয়েছিল এক স্বপ্নের, যা আজও মোহিত করে রেখেছে কোটি কোটি ভারতীয়কে। ‘ডিস্কো ডান্সার’ কত মানুষকে নতুন করে স্বপ্ন দেখিয়েছে! এখন আর মিঠুনকে স্পটবয় হয়ে অন্য অভিনেতাদের ব্যাগ বয়ে বেড়াতে হয় না। ‘নেপোটিজম’-এর শিকার হতে হয় না। এবার তিনি নিজেই হয়ে উঠলেন কয়েক হাজার মানুষের বেঁচে থাকার ভরসা। ভারতের গণ্ডি টপকে বিদেশেও শুরু হয় মিঠুন-রাজ। নয়তো কাজাখস্তানে এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার পরই কয়েক লাখ মানুষ শুধু তাঁকে দেখার জন্যই জড়ো হয়! কেবলমাত্র মিঠুন চক্রবর্তীর আগমনের জন্যই সেইদিন কাজাখস্তানের রাষ্ট্রপতির সভা বাতিল হয়। এমন ‘স্পর্ধা’ কারই বা থাকবে মিঠুন ছাড়া!

আরও পড়ুন
প্রথম জীবনে ছিলেন গ্রন্থাগারিক, সংবাদপত্রে ব্যঙ্গচিত্রও এঁকেছেন বাসু চট্টোপাধ্যায়

আজও কলকাতা বা মফস্বলের কোনো বাড়ির কোণে চুপ করে বসে আছে কোনো এক গৌরাঙ্গ। যে খালি স্বপ্ন দেখেই যাচ্ছে, আর চারিদিক থেকে হেরে যাওয়া গ্রাস করছে তাঁকে। বাড়ি থেকে পালিয়ে কোনো তরুণ হয়তো উপস্থিত হচ্ছে মুম্বইতে, চোখে জ্বলছে অজস্র তারা। বাস্তবের অদ্ভুত সমাজের দাপটে সেই তারাগুলো হয়তো নিভে যেতে থাকবে। খাদের কিনারায় এসে দাঁড়াবে সে। তখনই তার কানে কানে মন্ত্র বলে যাবেন মিঠুন চক্রবর্তী। যদি তোমার মধ্যে কিছু থাকে একদিন না একদিন তুমি শিখরে উঠবেই। কোনো গডফাদার কিচ্ছু করতে পারবে না। কোনো নেপোও এসে দই খেয়ে যাবে না। সেখানে তুমিই রাজা; তুমিই ‘দ্য ওয়ান অ্যান্ড অনলি’।

আরও পড়ুন
মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায় ও একটি 'আকাশ কুসুম' বিতর্ক

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
স্বপ্ন মিঠুন চক্রবর্তীকে ফুচকা খাওয়ানো, কলকাতায় জীবনের লড়াই ১৬ বছরের রামপ্রবেশের

More From Author See More