বাংলা টেলিভিশনের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ‘কাল্ট শো’ বলতে যেটা বোঝায়, ‘মীরাক্কেল’ একরকম তাই। দুই বাংলাতেই অত্যন্ত জনপ্রিয় কমেডি নির্ভর এই রিয়েলিটি শো। দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থেকেছে প্রখ্যাত সঞ্চালক মীর আফসার আলি, অর্থাৎ, সকলের পরিচিত মীরের সঞ্চালিত এই অনুষ্ঠানটি। কিন্তু সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত একটি ঘটনার ফলে দাগ লেগে গেল বলে মনে করা হচ্ছে এই ‘কাল্ট’ শোয়ের গায়েও।
জনপ্রিয় টেলিভিশন শো ‘মীরাক্কেল’ থেকে বাদ পড়লেন এই অনুষ্ঠানের বিচারক হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করে আসা অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেই এই কথা জানিয়েছেন অভিনেত্রী। পরবর্তীকালে একটি ভিডিও-তে আরও স্পষ্ট করেছেন তাঁর বক্তব্য। আর সেই সঙ্গেই সর্বভারতীয় কিছু বাংলা এবং ইংরেজি দৈনিকে চর্চা শুরু হয়েছে, শ্রীলেখা মিত্রের পরিবর্তে কারা হতে পারেন এই অনুষ্ঠানের অন্যতম বিচারক। সুতরাং এক্ষেত্রে কোন অনুষ্ঠানটির কথা বলা হচ্ছে তা বুঝে নিতে শার্লক হোমস হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।
কথা হল, বর্তমানে পেশাদার ফ্র্যাঞ্চাইজি ভিত্তিক যে কোনও অনুষ্ঠান বা রিয়েলিটি শোতে অপরিহার্য কেউই নন, এ কথা সত্যি। কিন্তু শ্রীলেখা মিত্রের এই অপসারণের পিছনে সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর খোলামেলা কথাবার্তা এবং তার ফলে আমদানি হওয়া বিতর্কেরই হাত দেখতে পাওয়া যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। অভিনেত্রীর নিজের দাবি, সত্যি বলার খেসারত হিসেবেই তাঁকে বাদ পড়ে যেতে হল মীরাক্কেলের নতুন সিজন থেকে। তবে মীরাক্কেল থেকে বাদ পড়ার কষ্টের থেকেও বোধ হয় শ্রীলেখার বেশি বিঁধেছে পেশাগত সৌজন্যের খাতিরেও এর সঙ্গে জড়িত কেউই তাঁকে বিষয়টা জানানোর প্রয়োজন বোধ করলেন না বলে।
https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10219020025276352&id=1376432968
আরও পড়ুন
বিশ্বভারতী এবং একটি পাঁচিল: রবীন্দ্রনাথের শিক্ষারীতির ভিতটাই দুর্বল হয়ে পড়ছে কি?
সাম্প্রতিক সময়ে সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যুর পর থেকেই ‘নেপোটিজম’ ইস্যুতে সরগরম হয়েছে চলচ্চিত্র জগৎ। বাদ পড়েনি টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিও। স্বজনপোষণ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একাধিক বোমা ফাটিয়ে ছিলেন অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র। যথেষ্ট যোগ্যতা সত্ত্বেও সেই পরিমাণে কাজ তিনি পাননি বলে ফেটে পড়েছিলেন ক্ষোভে। রুপোলি পর্দার পিছনের অন্ধকার দিকটি যেন আচমকাই সামনে চলে এসেছিল শ্রীলেখা মিত্রের বক্তব্য ঘিরে। এমনকি সারা দেশ যাঁদের এক নামে চেনে, টলিউডের সেই পর্দা কাঁপানো জুটিকেও ছেড়ে কথা বলেননি তিনি। কিন্তু যথেষ্ট প্রতিশ্রুতি জাগিয়ে শুরু করলেও শ্রীলেখা তাঁর কেরিয়ারে খুব বেশি কাজ যে করে উঠতে পারেননি, সে কথা তো মিথ্যে নয়! এর জন্য সরাসরি স্বজনপোষণকে দায়ী করে শ্রীলেখা লিখেছিলেন, নায়িকা হতে গেলে গডফাদার অথবা নায়ক অথবা পরিচালকদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখা ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় বাধ্যতামূলক। সেই শর্তে রাজি হননি বলেই ভালো অভিনেত্রী হিসেবে মেনে নিয়েও নায়িকার চরিত্র কেউ আর দিয়ে ওঠেননি তাঁকে।
স্বাভাবিকভাবেই বিতর্ক ওঠার কথাই ছিল শ্রীলেখার এই বক্তব্য নিয়ে। পক্ষে-বিপক্ষে চলেছিল উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়। তবে শুধু এই একটি বিষয় নিয়েই নয়, বারবারই বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছেন শ্রীলেখা। কখনও লকডাউনের সময় রাস্তার কুকুরদের খাবার খাওয়ানোর জন্য বিরুদ্ধতার মুখে পড়তে হয়েছে তাঁকে। কখনও বা ছোট পোশাক পরার জন্য শুনতে হয়েছে নানান অপমানজনক মন্তব্য। শ্রীলেখা নিজে জানিয়েছিলেন প্রথমত তিনি একা, দ্বিতীয়ত তিনি মহিলা, আর তৃতীয়তঃ, তিনি অভিনেত্রী বলে এত সহজে আক্রমণ এবং ট্রোলিংয়ের সামনা-সামনি হতে হচ্ছে তাঁকে। প্রশ্ন হচ্ছে, তবে কি পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একা নারীদের এভাবেই সমস্ত অপমান সয়ে পথ চলা অভ্যাস করে নিতে হবে? শ্রীলেখা বলছেন, তাঁর অভিজ্ঞতায় একজন যে কোনও একজন পুরুষের সঙ্গে থাকলেই তাকে অবশ্যই এই ধরনের ব্যবহারগুলো সহ্য করতে হত না।
ধাঁধা লাগছে আরও কয়েকটি বিষয় নিয়ে। যে নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানটি থেকে শ্রীলেখাকে বাদ দেওয়া হল, তাঁর পরিচালক, সঞ্চালক, অথবা বিচারকমণ্ডলী সকলকেই কেরিয়ারের একটা পর্যায়ে অত্যন্ত স্ট্রাগল করে জায়গা করে নিতে হয়েছে ইন্ডাস্ট্রিতে। মীরাক্কেলও নতুন প্রতিযোগীদের ভবিষ্যতের শক্তি জমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, এমন উদাহরণও নেহাত কম নেই। সঞ্চালক মীর অথবা বিচারক রজতাভ দত্ত কিংবা পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, এঁরা সকলেই চূড়ান্ত প্রতিভাবান হয়েও দীর্ঘদিন লড়াই করে ইন্ডাস্ট্রিতে থেকে শক্ত করেছেন পায়ের নীচের জমি। চলতি শব্দের পরিপ্রেক্ষিতে, ‘বহিরাগত’ ট্যাগ মীরের গায়েও তো অবশ্যই লাগিয়ে দেওয়া যায়। তবু যোগ্যতা থাকলে এবং পরিশ্রম করলে যে আসল প্রতিভাকে আটকে রাখা যায় না কিছুতেই, মীর আসরাফ আলীর থেকে বড় উদাহরণ এই ক্ষেত্রে আর কী হতে পারে? দিনের পর দিন একটা গোটা অনুষ্ঠান চলছে একজন সঞ্চালকের নামের সঙ্গে মিল রেখে, এমন উদাহরণও তো খুব বেশি নেই।
সেই অনুষ্ঠানেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন যে মহিলা, তাঁকেই নাকি স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে মুখ খোলার জন্য এইভাবে শাস্তির খাঁড়া মাথা পেতে নিতে হল, তা যেন হজম হচ্ছে না কিছুতেই। নিতান্তই শোয়ের গুণগত মান বাড়ানোর জন্যই যদি শ্রীলেখাকে বাদ দেওয়া হবে তবে অফিশিয়ালি একবার অন্তত জানানো যেত না তাঁকে, এই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য বৈকি! তাহলে কি এখানেও সেই পাওয়ার গেমের অঙ্ক? আসলেই উপর থেকে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী কারুর আঙুল ঘোরানোতেই ঘটে যায় সকল বিপত্তি? ইন্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে কথা বললে ইন্ডাস্ট্রি কি এভাবেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় তাহলে? প্রশ্নগুলো কিন্তু উঠছে। আজকে যদি শ্রীলেখা মিত্র এই ঘূর্ণিপাকে পড়ে যেতে পারেন, আগামীকালে তো সোজাসাপ্টা বক্তব্য রাখার জন্য আরও অনেককেই সামনাসামনি হতে পারে এই পরিস্থিতির। টলিউডের একচিলতে আকাশে কীভাবে দেখা মিলবে তাহলে খোলা বাতাসের?
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Powered by Froala Editor