পেরিয়ে গেল আরও একটি প্রজাতন্ত্র দিবস। রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পদ্মশ্রী পুরস্কার পেলেন ১০২ জন ভারতীয়। নিজের নিজের ক্ষেত্রে তাঁরা প্রত্যেকেই দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। তবে সকলের মধ্যে থেকেও সবার চেয়ে আলাদা আলি মানিকফান। তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্রটিই নির্দিষ্ট নয়। সমুদ্রবিজ্ঞান থেকে শুরু করে জ্যোতির্বিদ্যা বা প্রযুক্তিবিদ্যা, সবেতেই সমান পারদর্শী আলি মানিকফান। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, কোনোকিছুতেই প্রথাগত কোনো শিক্ষা নেই তাঁর।
১৯৩৮ সালে লাক্ষাদ্বীপের মিনিকয় দ্বীপে জন্ম মানিকফানের। তাঁর পরিবার অভিজাত হলেও পড়াশোনার রেওয়াজ তেমন ছিল না। অবশ্য তাঁকে পড়াশোনার জন্য কেরালা পাঠানো হয়। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনার পর আর কেরালায় থাকতে পারেননি তিনি। ফিরে গেলেন মিনিকয়ে। তবে ততদিনে নানা বিষয়ে জন্ম নিয়েছে তাঁর আগ্রহ। বাড়ি ফিরে প্রথমেই নিজে নিজে শিখতে শুরু করলেন দেশবিদেশের নানা ভাষা। ইংরেজি, হিন্দি, মালায়ালম তো আছেই; তার সঙ্গে শিখলেন আরবি, ল্যাটিন, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, রুশ, সিংহলিজ, পার্সি, সংস্কৃত, তামিল, উর্দু। তবে শুধু ভাষা শিক্ষার মধ্যেই থেমে থাকল না তাঁর পরিধি।
সমুদ্রের বুকে জন্ম মানিকফানের। তাই সেখানকার জীবেদের জীবন, জলের প্রকৃতিই আকর্ষণ করল সবার আগে। সেই শিক্ষাও নিজের উদ্যোগেই। তবে তার গভীরতা অনেক বিশেষজ্ঞকেও হার মানাবে। মূলত তাঁর পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভর করেই জীববিজ্ঞানী ডঃ শান্তপন জোনস আবিষ্কার করে ফেললেন নতুন একটি মাছের প্রজাতি। আর তার নামও রাখা হয় মানিকফানের নামেই। আবুদেফডাফ মানিকফানি। শুধুই কি জীববিজ্ঞান? কারিগরি বিষয়েও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। আইরিস অভিযাত্রী দল টিম সার্ভিন তখন পরিকল্পনা নিয়েছিলেন ওমানের সোহার শহরের একটি প্রাচীন জাহাজে চড়ে অভিযানে নামবেন। কিন্তু সেই ভগ্নপ্রায় জাহাজের মেরামতি দরকার। সমস্ত কারিগররাই যখন হাত গুটিয়ে নিলেন, তখন এগিয়ে এলেন মানিকফান। একাই নতুন করে গড়ে তুললেন সেই জাহাজ। আর অভিযানও সফল হল।
জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়েও তাঁর জ্ঞান অবাক করে। মুসলমান সম্প্রদায়ের বহু মানুষকে তিনি বোঝাতে সমর্থ হয়েছেন, আলাদা কোনো ধর্মীয় পঞ্জিকা ব্যবহার করা উচিৎ নয়। পঞ্জিকা হবে সকলের জন্য এক। তবে চান্দ্রমাসের হিসাব মেনে কোনো আন্তর্জাতিক পঞ্জিকা নেই। তাই সেই কাজটাও তিনিই করলেন। তৈরি করে ফেললেন আস্ত একটি আন্তর্জাতিক পঞ্জিকা। নিজের জীবন দিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না করেও মানুষের সভ্যতা কীভাবে টিকে থাকতে পারে। তামিলনাড়ুতে তাঁর বর্তমান বাসভবনের আশেপাশের ১৫ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তুলেছেন একটি বায়ুকল। তাও সম্পূর্ণ নিজের হাতে। বাড়ির বিদ্যুতের জন্য পরিবেশ ধ্বংসকারী তাপবিদ্যুৎ ব্যবহার করেন না তিনি। নিজের হাতেই তৈরি করে ফেলেছেন নিজস্ব রেফ্রিজারেটর মেশিন। তার থেকে বাতাসে সিএফসি মেশার কোনো সম্ভাবনা নেই। ঠিক কোন বিষয়ে তাঁকে বিশেষজ্ঞ বলা যায়, তা সত্যিই জানা নেই। অথচ এই বহুমূখী মানুষটির প্রথাগত শিক্ষা মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। জিনিয়াসরা বোধহয় এমনই হন।
Powered by Froala Editor