একবছর পেরিয়েও থমকে প্রক্রিয়া, নাগরিকত্ব ‘প্রমাণে’র সুযোগই পাননি অসমের ১৯ লক্ষ বাঙালি

দিনটা ছিল ৩১ আগস্ট। ২০১৯। অর্থাৎ আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে এই দিনেই প্রকাশিত হয়েছিল অসম এনআরসি’র চূড়ান্ত তালিকা। আর সেখানেই নাগরিকত্ব থেকে বাদ পড়েছিলেন ১৯ লক্ষ মানুষ। তারপর পেরিয়ে গেছে একটা দীর্ঘ বছর। কিন্তু এখনও পাকাপাকিভাবে তাঁরা কোনো সরকারি নোটিস অর্থাৎ ‘স্পিকিং অর্ডার’ পাননি তাঁরা। হিসাব মতো তাঁদের নাগরিকত্ব এখনও বাতিল হয়নি। ফলে ফরেনার্স ট্রাইবুনালে তাঁরা এখনও অবধি মামলা দায়ের করে উঠতে পারছেন না নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য। আইনের বেড়াজাল কার্যত তাঁদের থেকে কেড়ে নিচ্ছে প্রতিদিনের ঘুম। ঠেলে দিচ্ছে এক অনিশ্চয়তা, দুর্ভোগের দিকে। কিন্তু এই পরিস্থিতির পিছনে লুকিয়ে আছে কোন ট্র্যাজেডি?

এনআরসি’র দায়িত্বে থাকা অসমের আধিকারিকরা জানাচ্ছেন, কোভিড-১৯ পরিস্থিতির জন্যই এই দুর্ভোগ। অধিকাংশ আধিকারিকরাই এখন বন্য এবং মহামারী নিয়ন্ত্রণের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় থমকে আছে নাগরিকত্ব সংশোধনের কাজ। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া অবধি এখন সাধারণ মানুষকে অপেক্ষা করতে হবে বাকি প্রক্রিয়াকরণের জন্য। এমনটাই বক্তব্য অসমের সরকারি কর্মীদের।

তবে সমালোচক এবং সমাজকর্মীদের বয়ানে উঠে আসছে ভিন্ন ছবি। এই দেরি হওয়ার পিছনে পরিস্থিতির হাত অনেক পরের কথা। কারণ, মহামারী ভারতে ছড়িয়েছিল গত মার্চ মাস থেকে। আসাম বন্যার হয়েছে তারও পরে। কিন্তু গত আগস্টে তালিকা প্রকাশের পরেও অন্তত ৭ মাস থমকে ছিল কাজ। কেউ কেউ আঙুল তুলছেন সরকারের দিকেই।

অসমের সরকারি নথি খুঁজলেই উঠে আসে চাঞ্চল্যকর এক তথ্য। ২০১৩ সাল থেকেই অসমের এনআরসি’র দায়িত্বে ছিলেন কো-অর্ডিনেটর প্রতীক হাজেলা। তালিকা প্রকাশের ঠিক পরপরই কয়েকদিনের মধ্যেই তিনি জারি করেছিলেন একটি আভ্যন্তরীণ ফরমান। যাতে স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবরের মধ্যেই নাগরিকত্ব থেকে বাদ যাওয়া ব্যক্তিদের নামের সত্যতা যাচাই এবং ডিজিটালিজেশন করতে হবে। এই ফরমান জারির সঙ্গে সঙ্গেই ১৮ অক্টোবর তাঁকে বদলি করে দেওয়া হয় মধ্যপ্রদেশে। কারণ হিসাবে কোর্ট জানায়, “নো অর্ডার উইথআউট আ রিসন।” এটুকুই। সে-রাজ্যের শাসক দলের সদস্যদের রোষের মুখেও পড়তে হয় তাঁকে।

১১ নভেম্বর সেই পদের দায়িত্ব দেওয়া হয় হিতেশ দেব শর্মাকে। সরকারের সেই সিদ্ধান্ত ঘিরে তৈরি হয় আরও একটি বিতর্ক। তাঁর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে যখন অসমে উত্তাপ বাড়ছে, ঠিক তখনই এক মাসের জন্য স্বেচ্ছা-ছুটি নিলেন হিতেশ শর্মা। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের সর্বোচ্চ বিচারপতি রঞ্জন গগৈ, যিনি এনআরসি সংক্রান্ত সমস্ত আইনিবিচারের দায়িত্ব ছিলেন, অবসরগ্রহণ করেন নভেম্বর মাসেই। ফলে বৃথা যায় প্রতিবাদের সেই মহড়াও। 

অসমে এনআরসি প্রথম লাগু করা হয়েছিল ১৯৫১ সালে। তৎকালীন গণনা অনুযায়ী দেশভাগের পর ভারতে আসামে প্রবেশ করা শরণার্থীদের চিহ্নিত করাই ছিল তার উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গেই তা ক্রমশ ধাক্কা পেতে থাকে। অসমের সম্ভাব্য পাইলট প্রোজেট ২০১০ সালে ব্যর্থ হওয়ার পর ২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্ট নিজেই এই দায়িত্ব তুলে নেয়। সর্বোচ্চ আদালত সরকারের কাছে অনুরোধ জানায়, দ্রুত প্রক্রিয়াটির পর্যালোচনা করার জন্য। উদ্দেশ্য ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের মধ্যরাতের পর অর্থাৎ বাংলাদেশের যুদ্ধের পর ভারতে আসা শরণার্থীদের নাগরিকত্বের সংশোধন করা। যাঁদের কাছে পর্যাপ্ত প্রমাণ থাকবে না, তাঁদেরকে স্থানান্তরিত করা হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। তবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এই ধরণের কোনো প্রবাসী-চুক্তি নেই। ফলে তাঁরা বাংলাদেশের নাগরিক, সে বিষয়েও তথ্য নেই কোনো। শুধু রয়ে যাচ্ছে ধোঁয়াশা।

আরও পড়ুন
কবিতায় প্রতিবাদ এনআরসি-র, বইমেলায় প্রসূন ভৌমিকের নতুন কবিতার বই

তবে এনআরসি’র প্রথম থেকে অবস্থান পরিষ্কার করে দিয়েছিল ভারতীয় জনতা পার্টি— বাংলাদেশ থেকে আসা ‘মুসলিম অনুপ্রবেশকারী’-দের নির্বাসন। তাই তালিকা প্রকাশ্যে আসার পরই তা প্রত্যাখ্যান করে দলটি। সন্দেহ করে, তালিকায় মুসলিমদের থেকে বাদ পড়া হিন্দুদের সংখ্যা বেশি। যদিও এনআরসি পরিষদ এই ধরণের জনতাত্ত্বিক তথ্য প্রকাশ্যে আনেনি। আসাম সরকার একটি পিটিশন জমা দেয়, যাতে আসামের দক্ষিণের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় থাকা ২০ শতাংশ মানুষদের আরও একবার তথ্য যাচাই করানো হয়। কারণ অসমের এই অংশগুলিতে বাঙালি মুসলিম আধিক্য বেশি। সরকারের এই সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের সঙ্গে অদ্ভুতভাবেই মিল থেকে যায় প্রতীক হাজেলার দায়িত্ব খর্ব এবং হিতেশ শর্মার পদাসীন করার ঘটনার।

এই পুনর্বিচার বা সমীক্ষা করার জন্য অসমে তৈরি করা হচ্ছিল ২০০ ফরেনার্স ট্রাইবুনাল। আর এই নতুন ট্রাইবুনালগুলির জন্য দরকার পড়ে বিপুল পরিমাণ নতুন কর্মীর। ২২১ টি বিচারকের পদ এবং ১৬০০ সহকারীকর্মীর শূন্যস্থান মেটাতে অসমে পরীক্ষা দিয়েছিলেন কয়েক লক্ষ পদপ্রার্থী। থমকে আছে তাঁদের নিয়োগের প্রক্রিয়াও। অথৈ জলে পুরো প্রক্রিয়াকরণের পরিকাঠামোও। নাগরিকদের তো বটেই এই রাজনৈতিক ঘটনাবলির প্রেক্ষিত বিশবাঁও জলে রেখে দিয়েছে পরীক্ষার্থীদেরও। মাঝে মাঝেই চড়াও হচ্ছে বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদের সুর। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান ঠিক কবে হবে, তার সদুত্তর নেই প্রশাসনিক মহলে...

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

আরও পড়ুন
এনআরসি-সিএএ’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মঞ্চ রাজাবাজারে, রাত জাগছে শিশুরাও

Powered by Froala Editor

More From Author See More