সমুদ্রের তলায় হাজার হাজার যুদ্ধযান, কোথায় রয়েছে এই আশ্চর্য ‘সমাধিক্ষেত্র’?

সমুদ্রের তলদেশে পড়ে রয়েছে অজস্র জিপ, ফর্কলিফট, বুলডোজার, সেমিট্রেলার, কামান, ট্যাঙ্ক ও হরেক কিসিমের যুদ্ধাস্ত্র। তার ওপরেই গজিয়ে উঠেছে শ্যাওলা, প্রবাল। পরিত্যক্ত মরচে ধরে যাওয়া সে-সব যুদ্ধযানের ভেতরে লাল-নীল মাছেদের সংসার। এ এক আশ্চর্য দৃশ্যই বটে। দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত দ্বীপ রাষ্ট্র ভানুয়াতুতে (Vanuatu) গেলেই দেখা মিলবে এহেন দৃশ্যের। যে-অঞ্চলের পোশাকি নাম ‘মিলিয়ন ডলার পয়েন্ট’ (Million Dollar Point)। 

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এত এত যুদ্ধাস্ত্র, যুদ্ধযান কীভাবে তলিয়ে গেল জলের তলায়? কোন মহাপ্রলয় ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল মানুষের বিরুদ্ধে? না, কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়। আসলে এইসব যুদ্ধাস্ত্র ও সামগ্রী মানুষ স্বয়ং নিজের হাতে সমাধিস্থ করেছে সমুদ্রবক্ষে। কিন্তু তার কারণ কী? 

উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে প্রায় ৮০ বছর আগে। ১৯৪১ সাল। যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবারে বিধ্বংসী আক্রমণ চালায় জাপান। তারপরই আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধের ময়দানে পা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ইউরোপকেন্দ্রিক হলেও, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল জাপানই। তাই প্রশান্ত মহাসাগরকে সামরিকভাবে ব্যবহার করার জন্য বিশেষভাবে জোর দিয়েছিল মার্কিনিরা। 

সেই সূত্রেই প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত ভানুয়াতুয়ান দ্বীপের এস্পিরিতু সান্টো হয়ে ওঠে আমেরিকার অন্যতম সামরিক ঘাঁটি। এখান থেকেই জাপানের মূল ভূখণ্ডের দিকে আক্রমণ চালাত মার্কিন সেনারা। জরুরি তৎপরতায় তৈরি করা হয়েছিল একাধিক রানওয়ে, বড়ো বড়ো ভবন, হাসপাতাল, পাকা রাস্তা। গোলা-বারুদ, অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধযানও যথেষ্ট পরিমাণে মজুত রাখা হয়েছিল এই দ্বীপে। পরবর্তীকালে যা পণ্যবাহী জাহাজে করে পৌঁছে দেওয়া হত যুদ্ধক্ষেত্রে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ভানুয়াতু ছাড়তে হয় মার্কিনিদের। কারণ, এই দ্বীপ তাদের অন্যতম ঘাঁটি হলেও, আনুষ্ঠানিকভাবে তা ব্রিটেন ও ফ্রান্সের উপনিবেশ। কিন্তু সমস্যা বাধে অন্য জায়গায়। পাঁচ বছর ধরে ধীরে ধীরে গড়ে তোলা এই সাম্রাজ্যজুড়ে যে ছড়িয়ে রয়েছে মার্কিন সেনাদের বিভিন্ন সামরিক অস্ত্র, প্রয়োজনীয় অন্যান্য সামগ্রী ও যুদ্ধযান। সেগুলিকেও তো দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। তবে তেমনটা করতে গেলে প্রয়োজন বড়ো অঙ্কের অর্থ। বিশ্বযুদ্ধের শেষে যেখানে অর্থনৈতিক মন্দা দেশজুড়ে, সেখানে বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে সামরিক সামগ্রী দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া এক প্রকার বোকামিই বটে। ফলে, সে-সব সামগ্রী ভানুয়াতুতেই ছেড়ে রেখে যেতে বাধ্য হয় মার্কিনিরা। 

অবশ্য ‘ছেড়ে যাওয়া’ বললে ভুল হবে। কারণ, এইসকল মার্কিন প্রযুক্তি ব্রিটিশ ও ফরাসি বৈজ্ঞানিক ও সেনাদের হাতে পৌঁছে যাক, এমনটা একেবারেই চায়নি যুক্তরাষ্ট্র। ফলে সাগরের জলেই সমাধিস্থ করা হয় এই যুদ্ধ সরঞ্জাম। অন্যদিকে দৈনন্দিনের ব্যবহারিক সামগ্রী, খাদ্যদ্রব্য ও কোকাকোলার বোতল জলের দরে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল ভানুয়াতুর ব্রিটিশ ও ফরাসি ঔপনিবেশিকদের। 

তবে মার্কিনিদের এই কূটনৈতিক জয় পরিবেশে প্রভাব ফেলেছিল ভয়াবহ। জ্বালানি তেল, রাবার ও অন্যান্য বিষাক্ত ধাতু সমুদ্রের জলে মিশে সে-সময় প্রাণ কেড়েছিল বহু সামুদ্রিক প্রাণীর। অবশ্য তা নিয়ে তৎকালীন সময় বড়ো কোনো প্রতিবাদ দেখা যায়নি কোথাও-ই। আট দশক পর আর প্রকৃতি নিজেই নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে এই পরিস্থিতির সঙ্গে। সমুদ্রবক্ষে জমে থাকা পরিত্যক্ত যুদ্ধসামগ্রীর ওপরেই গজিয়ে উঠেছে প্রাণ, আশ্রয় নিয়েছে সামুদ্রিক মাছ, কাঁকড়া ও অন্যান্য প্রাণীরা। স্থানীয় মানুষদের লাভও কম হয় না। সমুদ্রের তলদেশে অবস্থিত এই ‘প্রত্নক্ষেত্র’ দেখতে প্রতিবছর ভিড় জমান লক্ষ লক্ষ মানুষ। পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে স্কুবা ডাইভের ব্যবসা। তাছাড়াও জলের নিচে ‘গুপ্তধন’-এর অনুসন্ধানও চালান স্থানীয়রা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাচীন সামগ্রী তুলে এনে ‘প্রত্নপণ্য’ হিসাবে বিক্রি করে উপার্জন করেন লক্ষ লক্ষ টাকা। বলতে গেলে এই ‘ট্রেজার হান্টিং’-এর কারণেই ভানুয়াতুর এই অঞ্চল পরিচিত ‘মিলিয়ন ডলার পয়েন্ট’ নামে। 

Powered by Froala Editor