আজ থেকে বছর পাঁচ-ছয়েক আগেকার কথা। সালটা ২০১৪-১৫। আফগানিস্তান, সিরিয়া, ইরাক এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশেরই অবস্থা ভয়াবহ। সেই সঙ্গে আফ্রিকারও একাধিক দেশে পরিস্থিতি বেশ জটিল। হয় যুদ্ধবিদ্ধস্ত নয়তো সেখানে ছড়িয়েছে আঞ্চলিক হিংসা, দাঙ্গা, গৃহযুদ্ধ। এই দেশগুলি থেকে স্রেফ প্রাণ বাঁচাতে এই সময় পালিয়ে যাচ্ছিলেন হাজার হাজার মানুষ। সুস্থ জীবনের খোঁজে সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি দিচ্ছিলেন অন্য দেশে। কিন্তু গন্তব্য? ইউরোপের উন্নত দেশগুলি। তবে ২০১৫-য় শুধু জার্মানিই জায়গা দিয়েছিল প্রায় ১০ লক্ষ শরণার্থীদের। তার মধ্যে এক পঞ্চমাংশই ছিল শুধু আফগান।
এই সময়ই ভাগ্যচক্রে জার্মানিতে এসে পড়ে পাকিস্তানের পেশোয়ার শহরের কিশোর আব্দুল শাকুর রাহিমজি। তবে তার লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ড। ইচ্ছে ছিল ব্রিটেনের ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার। সেই সঙ্গে বিদেশি পরিকাঠামোয় তৈরি করা স্বপ্নের ক্রিকেট কেরিয়ার। কিন্তু একাধিক চেষ্টা করেও জোগাড় হল না পাসপোর্ট। কিন্তু তাকে ইংল্যান্ড যেতেই হবে যে-কোনো প্রকারেই। অনেকটা জেদের বসেই অবৈধভাবে ব্রিটেনপাড়ির পরিকল্পনা করে শাকুর। এই পরিকল্পনার অংশীদার ছিল আরও বেশ কয়েকজন বন্ধু। পাসপোর্ট না থাকায় পায়ে হেঁটে, লুকিয়ে একাধিক সীমান্ত পেরোনোর ছক তৈরি করে তারা।
ইতিমধ্যেই বছর খানেক আগে শাকুর একবার তুরস্ক-ভ্রমণ করে ফেলেছে। ইরান থেকে পায়ে হেঁটে সেখানে যেতে সময় লাগে দু’দিন। সুতরাং রাস্তাও চেনা মোটামুটি। তোড়জোড় শুরু করে শাকুর। আত্মীয়দের থেকে জোগাড় করে ফেলে ২০০০ মার্কিন ডলার। বাড়ির কাউকে না জানিয়েই রওনা দেয় ইউরোপের উদ্দেশ্যে।
বাস অথবা গাড়িতে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে পৌঁছে, পায়ে হেঁটেই সীমান্ত অতিক্রম করত শাকুর। পাকিস্তান, ইরান হয়ে তুরস্কতে এভাবেই প্রবেশ করে সে। তবে দুঃসাহসিক এই অভিযান প্রথমে পরিকল্পনা মাফিক হলেও সমস্যা দেখা দিল তুরস্কতে। জেদের বশে পালিয়ে আসা শাকুরের ধারণা ছিল না পুরো যাত্রাটার খরচের ব্যাপারে। তুরস্কতে যখন পৌঁছেছে সে, প্রায় ফুরিয়ে এসেছে পকেট। অথচ তুরস্কর সীমানা পেরিয়ে বুলগেরিয়ে প্রবেশ করে নতুন এজেন্টকে দিতে হবে বড় অঙ্কের পারিশ্রমিক। অন্যথা পুলিশের কাছে ধরা পড়ার সম্ভাবনা। বাধ্য হয়েই বাড়িতে ফোন করে শাকুর। জানায় পুরো পরিকল্পনার কথা। আশ্চর্যজনক ভাবে খরচ যোগাতে রাজি হয়ে যান তাঁরাও।
কিন্তু এর পরেও আর বড় ট্র্যাজেডি অপেক্ষা করে ছিল। সীমান্ত পেরোনোর প্রথম প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দিল বুলগেরিয়ার পুলিশ। পরিচয় জানতে পেরে ধাওয়া করল তাদের পিছনে। বেশ কয়েকবার চলল গুলিও। আতঙ্কে তুরস্কের সীমান্তে ফিরতে গিয়েই তুর্কি সৈনিকের কাছে ধরা পড়ে যায় তারা। নিয়ে যাওয়া হয় রিফিউজি ক্যাম্পে। কিন্তু এতদূর এসে স্বপ্নভঙ্গ কি মেনে নেওয়া যায়? আবার বুলগেরিয়ার এজেন্টের সঙ্গে যোগাযোগ করে পাকিস্তানী কিশোরটি। আবার একটা দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা। তবে এবার পুলিশের কাছে ধরা না পড়লেও রাস্তা হারাল সে। ৪৮ ঘণ্টার রাস্তা পেরোতেই সময় লেগে গেল ৬-৭ দিন। ততদিনে ফুরিয়ে গেছে খাবার, পানীয় জলও। নদীর জল, গাছের আপেল খেয়েই বাকি পথ কোনোমতে অতিক্রম করে শাকুর। তবে বুলগেরিয়া প্রবেশের পর কোনো সমস্যা হয়নি সার্বিয়া, হাঙ্গেরি ঘুরে অস্ট্রিয়া পৌঁছাতে।
অস্ট্রিয়া পৌঁছে ইংল্যান্ডে থাকা বন্ধুর ফোন পায় শাকুর। আর সেই ফোনেই ঘেঁটে যায় সমস্ত পরিকল্পনা। অবৈধ শরণার্থীদের ব্রিটেন থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তখন। সুতরাং ব্রিটেনে পৌঁছনো সম্ভব হলেও কার্যত মূল্যহীন হয়ে যাবে তার সমস্ত শ্রম। বন্ধুর কথায় যাত্রাপথের ঠিকানা বদলে ফেলে শাকুর। ইংল্যান্ড নয়, তাকে পৌঁছাতে হবে জার্মানি। সেইমতো জার্মানিতে শরণার্থী হিসাবেই প্রবেশ করে শাকুর। জায়গা হয় রোজেনবার্গের একটি শিবিরে। শুধু শাকুর নয়, তার মতো ১৮ বছরের কম বয়সি আরো দেড় লাখ কিশোর কিশোরীকে জায়গা দিয়েছিল রোজেনবার্গ।
শুরুর দিনগুলো অবশ্য সহজ ছিল না। নতুন জায়গা, নতুন মুখ, নতুন ভাষা চারিদিকে। এসবের মধ্যেই কোথাও যেন ধোঁয়াশার মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছিল শাকুরের স্বপ্ন। অন্যদের মতো শাকুরের মাথাতেও ঘুরছিল একটাই কথা, তাকে জায়গা করে নিতে হবে নতুন এই দেশে। কিছুদিন পরে শরণার্থী শিবিরেই জার্মান ভাষা শিখতে থাকে সে। সপ্তাহ পিছু হাত খরচা মিলত ১০-১৫ ইউরো।
মাসখানেক বাদে শিক্ষিকাকে আদ্যন্ত স্বপ্নের কথাটা বলেই বসে শাকুর। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন। যে স্বপ্ন তাকে তাড়া করে নিয়ে গেছে বাড়ি থেকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল শাকুরের। ওই শিক্ষিকার সঙ্গী প্রবাসী এক ভারতীয় তখন জার্মানির একটি টেনিস-বল ক্রিকেট টিমের সদস্য। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই পাল্টে গেল শাকুরের জীবন। ওই ব্যক্তির সৌজন্যেই একঘেঁয়ে রিফিউজি ক্যাম্প থেকে মুক্তি পেল শাকুর। নতুন শহরে গিয়ে খুঁজে পেলো সবুজ মাঠ আর ব্যাট-বলের সখ্য।
এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি শাকুরকে। পড়াশোনা আর ক্রিকেট দুটোই চলেছিল সমান তালে। ডিপ্লোমা করার পর কাজও জুটে যায় নির্মাণকার্য তদারকির। তবে পাশাপাশি অন্য একটা পরিচয়ও আছে শাকুরের। আব্দুল শাকুর এখন জার্মানির জাতীয় ক্রিকেট দলের অন্যতম অঙ্গ। গত মার্চেই জার্মান জার্সি গায়ে সপ্তম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে ফেলেছে শাকুর। স্পেনের বিরুদ্ধে সংগ্রহ করেছে নিজের সর্বাধিক ৫৯ রানের ইনিংস।
জার্মানির আন্তর্জাতিক ক্রিকেট টিম? ফুটবল-পাগল এই দেশে ক্রিকেট হয় নাকি? আশ্চর্য লাগলেও এমনটাই সত্যি। একশো বছর আগে জার্মানিতে ক্রিকেটের প্রচলন থাকলেও ততটা জনপ্রিয় পায়নি। তবে এখন জার্মানিতে দ্রুত প্রসার হচ্ছে ক্রিকেটের। বিশ্ব র্যা ঙ্কিংয়ে জার্মানির স্থান এখন ৩২। উন্নয়নের হার যে-কোনো দেশের থেকেই বেশি। ২০১২ নাগাদ মাত্র ৭০টি ক্লাব ছিল জার্মানিতে। এখন সেই সংখ্যাটা দাঁড়িয়েছে ২৫০-এ।
বাইশ গজের প্রসঙ্গ উঠলেই প্রথমে ঝাঁক দক্ষিণ-এশীয় দেশগুলির কথাই উঠে আসে। আইসিসি র্যা ঙ্কিংয়ের নিরিখে প্রথম দশে মধ্যে অর্ধেকই এশিয়ার দেশ। অন্যদিকে অবাক করার ব্যাপার, আন্তর্জাতিক জার্মান দলের প্রায় সব খেলোয়াড়ই অভিবাসী। দলের ৯৫ শতাংশই এশিয়ার শরণার্থী। জার্মানি তাঁদের দিয়েছে মাথা গোঁজার ঠাঁই। শাকুরের মতোই এমন হাজার শরণার্থীদের স্বপ্নপূরণের দায়িত্ব নিয়েছে জার্মানি। যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে ফিরিয়ে এনে, দিয়েছে সুন্দর জীবন। নতুন দেশে এই যুদ্ধটাকেই জার্সি হিসাবে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছেন তাঁরা। কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দেশকে। ইউরোপিয়ান ক্রিকেট লিগে ইতিমধ্যেই ভালোরকম জায়গা করে নিয়েছে জার্মানি। এখন পাখির চোখ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের প্রথম সারির টুর্নামেন্ট। সেই লক্ষ্যেই জান লড়িয়ে দিচ্ছেন শাকুরের মতো শরণার্থীরা। আইসিসির বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে জার্মানিকে দেখতে পাওয়া এখন হয়তো সময়েরই অপেক্ষা। যতটুকু সময় লাগে একটা জীবনের ঋণ শোধ করতে…