পরিযায়ী কর্মীরাই কোভিডযোদ্ধা, বাঙুরে মরণপণ লড়াই সহদেব-জহিরুলদের

২০২০, মার্চের ২৫ পেরিয়ে রাস্তায় নেমে এল পরিযায়ী শ্রমিকের পরিবার। গন্তব্য জানা ছিল। কিন্তু ফেরার পথ রাতারাতি হয়ে গেল দুর্গম। অনেকেই রুটিনের বাইরে রওনা দিলেন দেশের বাড়ি। কেউ কেউ হারিয়েই গেলেন চিরতরে। গ্রামে যারা পৌঁছলেন, তারাও রাতারাতি জায়গা পেলেন সন্দেহের তালিকায়। কে করোনা আক্রান্ত, আর কে নন, তা বুঝে ওঠার আগেই জায়গা হয়েছিল কোয়ারেন্টাইন শিবিরে। সোয়াব টেস্টের পর অধিকাংশই তখন করোনা আক্রান্ত। ভারতে করোনার প্রথম লকডাউন ঘোষণার পর এমনই হাজারো গল্প ও দৃশ্য পেরিয়ে টানটান ১৬ মাস অতিক্রান্ত। পশ্চিমে বা উত্তর ভারতে জনমজুর খাটা রাজমিস্ত্রী, সোনার কারিগর, ছোটো কারখানার শ্রমিক, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে পরিশ্রম করে সংসার চালানো মানুষজন - ক্যালেন্ডারের পাতা টপকে এখন - কৃষিমজুর, হকার বা আমার আপনার পাড়ার সব্জিবিক্রেতা। কেউকেউ লকডাউন শিথিল হবার পর ফিরে গেছেন উত্তরে বা পশ্চিমে। নাজেহাল কেউ কেউ এখনও খুঁজে চলেছেন আয়ের বিকল্প পথ।

কৃষি অর্থনীতির বদল, নগরায়ন, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা অন্য কারণে এ রাজ্যের গ্রামেগ্রামে পরিযায়ী শ্রমিক হওয়াটাই ছিল দস্তুর। নানান কাজ শিখে ঠিকাদার বা পরিচিতের হাত ধরে নতুন ভূগোলে পা দিয়ে রোজগারের লড়াই চালানো মানুষগুলোর যথাযথ নথি খুঁজে পাওয়া যায়নি। শহরে, শহরতলিতে, মফস্বলে নাগরিকের পাশে নাগরিকের বাঁচা ও বাঁচানোর লড়াইয়ে সামিল হয়েছে বাঙলার যৌবন। স্বাধীনতা, দেশভাগ, যুদ্ধ না দেখা প্রজন্ম নির্দ্বিধায় রচনা করেছে নাগরিকের স্বাভাবিক উত্তরণের পরম্পরা। মৃত্যুর অনজানা কারণ খুঁজতে খুঁজতে সমকাল স্বয়ংই যেন যোদ্ধা। তবু কত গল্প এখনও প্রকাশের অপেক্ষায়। জীবনস্রোতে আচমকা বদল কারো কারো জন্য রেখে গেল মহাকাব্যের প্লট।

মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম থানার সহদেব মার্জিত। বয়স ৩১। বাড়িতে বাবা-মা-স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে, ভরা সংসার। রাজমিস্ত্রীর কাজ শিখে বছর ১২ আগে চলে যান মহারাষ্ট্র। সব ঠিকঠাকই চলছিল। আন্ধেরির বস্তি ছেড়ে দেশে ফেরার অকাল তোড়জোড় শুরু হয় গতবছর এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। মিডিয়ায় তখন পরিযায়ী শ্রমিকের নিথর মুখ আর রক্তপায়ের ছাপ। মাঝরাতে লরিতে কোনোক্রমে ঠাঁই পাওয়া সহদেব দুদিন পর মুর্শিদাবাদের কান্দিতে পৌঁছন। দিন কয়েক পর গ্রামে পৌঁছে কৃষিজমিতে কাজ পান। একদিন স্হানীয় আশাকর্মীরা সোয়াব টেস্ট করলে জানা যায় - সহদেব কোভিড আক্রান্ত। রাতারাতি গ্রামীণ সমাজে অছ্যুৎ হয়ে যান ভিনরাজ্য থেকে ফেরা রাজমিস্ত্রী। পুলিশ পৌঁছে দেন বহরমপুর মাতৃসদনে। সেখানে ১১ দিন পার করে সঙ্গী হয়েছিলেন নতুন পরিচিতি - করোনা আক্রান্তরা। সবারই সঙ্গী পড়শির ঘৃণা আর আক্রান্তের অযাচিত লজ্জা।

এরপর, বর্ষা আসে বাংলায়। আমনের জমিতে কাজ বাড়ে।  রাজমিস্ত্রীর শক্ত হাত বীজতলা তৈরি বা বীজধান পোতার কাজে নতুন করে অভ্যস্ত হতে থাকে। ধানাজমিতে বাড়তে থাকে নতুন মুখ, পুরনো মুখ।

আরও পড়ুন
পরিযায়ী শ্রমিকের সন্তানদের জন্য স্কুল বেঙ্গালুরুর পুলিশকর্মীর

গতবছর জুনের প্রথম সপ্তাহে খড়গ্রাম থানার পুলিশ সোজা হাজির হয় জমিতে। "জেলাশাসক ডেকেছেন, কলকাতা যেতে হবে, কাজ আছে।" আবার নতুন কাজের দিকে বাসে উঠে বসা অসংখ্য সহদেবের ভিড়ে ঠাঁই হয় একদা রাজমিস্ত্রী, সাবেক কৃষিমজুরের। গল্প ছুটে চলে খড়গ্রাম থেকে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গণের দিকে, সোজ্জা কলকাতা।

আরও পড়ুন
কর্মক্ষেত্রে ফিরতে চাইছেন ৭০ শতাংশ পরিযায়ী শ্রমিকই

মুর্শিদাবাদের সহদেব মার্জিত, বাপন দেওয়ান, কোচ বিহারের বাবু হক, প্রসেনজিৎ দাস, সাহেব আলি, জহিরুল হকরা এরপর হয়ে উঠলেন কোভিডযোদ্ধা। স্বাস্হ্যকর্মী। সাহেব আলি ছিলেন দর্জি। বাকিরা সকলেই সহদেবের মত সিমেন্ট-বালি আর মাপজোখের মানুষ।

আরও পড়ুন
বৃষ্টিতে মাঠ ভরেছে সবুজে, কৃষিকাজে ফিরে স্বস্তি পরিযায়ী শ্রমিকদের

২০২০-র ৫ জুলাই বাঙ্গুর সুপারস্পেশালিটি হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে কাজ পান এই ৬ জন সাবেক পরিযায়ী শ্রমিক। পিছনের একমাসে সহদেবরা দেখেছেন, যুবভারতীর শিবিরে আসা ৩৪ জন শ্রমিকের ১৭ জন পালিয়ে গেলেন ভয়ে। বাকিরা ভয়ে জড়োসড়ো হয়েই ঢুকে পড়লেন মহামারীর মহাকক্ষে।

আমি কোভিড আক্রান্ত হয়ে গত ২২ জুলাই বাঙুর হাসপাতালে ভর্তি হই। এ পর্বে সর্বোচ্চ ১১ জন রোগী ছিলেন। ৩০ জুলাই আমি ছাড়া পাবার আগে পর্যন্ত ছিলাম ৫ জন। মধ্যরাত, ভোরে, দুপুরে ডাক্তার, নার্সদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিশ্রম করতে দেখেছি এই নতুন স্বাস্হ্যকর্মীদের। প্রবীন মুমূর্ষুকে আগলে রাখতে দেখেছি। প্রয়োজনে স্বস্নেহে বকতে দেখেছি। সাহস বাড়াতে জীবনের কথকতায় মজতে দেখেছি। জল, ওষুধ, পথ্য এগিয়ে দিতে দিতে কখনও মনে হয়নি ওরা অন্যকাজের মানুষ। মহামারীর এই ভয়ের আবহে কখন যেন জন্ম নিয়েছে মহাজীবন। তাদের কাছেই শুনছিলাম কোভিডের প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় যমে-মানুষে লড়াই। "অন্তত ২০০ মানুষকে মরতে দেখেছি দাদা। চিনি না জানি না, পরিজন, কাছের মানুষের চেয়ে দূরে থেকে আমরাই তাদের মৃত্যুকালের সঙ্গী। যাবার আগে কত কথা বললেন তাঁরা। এখনও শুনতে পাই সে সব কথা। মরার পর কতজনের হাত, হাত থেকে সরিয়ে রাখতে কষ্ট হয়েছে।" বলতে বলতে মার্জিত শ্রমিকের গলা ভারী হয়ে আসে। নিজেদের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে সহদেব বলেই ফেলে - "আমরা কি যোগ্য ছিলাম এ সবের? এই মহামারী আর মৃত্যুমিছিল আমাদের মূল্য বাড়িয়ে দিল। টাকার মূল্য এর কাছে কিছুই না।" বিগত বছরের স্মৃতি যখন আলোআঁধারি বুনছে, তখনও বাঙ্গুরের নিরলস কর্মীদের ভাবুক হওয়ার জোঁ নেই। নানান কাজের ফাঁকে সিস্টার ইনচার্জ তপতী দত্ত বলে গেলেন – “অসম্ভব ডেডিকেটেড আর বিনয়ী এই পরিযায়ী শ্রমিকদের শেখার আগ্রহ তীব্র। এই একটা বছর কলকাতার অন্যতম সেরা হাসপাতালের সেরা কোভিডযোদ্ধা ওরা সবাই।”

৩০ জুলাই দুপুরে আমার ছুটি। বিদায়বেলায় আবার সহদেবের সামনে। বললেন, এখন রোজ কলকাতার হাসপাতাল থেকে যুবভারতীর শিবিরে ফিরে যান ৭০ জন একদা পরিযায়ী শ্রমিক, এখন স্বাস্হ্যকর্মী। স্বাস্হ্য পরিষেবার এই কঠিন সময়ে তাদের দু-মাসের চুক্তি বাড়তে বাড়তে বছর পার। "আমরা এখন স্হায়িত্ব চাই দাদা। মাসে হাজার ১৫ টাকার নিশ্চয়তা আছে বটে, তার চেয়েও বেশি - এ কাজ আমাদের বড় মানুষ বানিয়ে ছেড়েছে।" কথায় কথায় ভারী গলায় উদয় হয় আনন্দ। বিদায় বেলায় দোতলার করিডোর দিয়ে লিফটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল - আমারই সন্তানকে কাঁধে নিয়ে অজানা পথে হাঁটতে হাঁটতে বাঙুরের কোভিড ওয়ার্ডে ঢুকে পড়লেন দানিশের ছবির পরিযায়ী কোনও শ্রমিক। নিষ্ঠা আর অবিরাম পরিশ্রমে যারা এ সভ্যতায় নামহীন থেকে জনপদ নির্মাণ করে হারিয়ে যান সময়ের গর্ভে। তাদেরই কয়েকজনের সেবা আর যত্নে সুস্থতা ছুঁয়ে জীবনে ফিরলাম আমরা কজন। এই মহাকালের মোড়ে মরা-বাঁচার সন্ধিক্ষণে - সহদেবদের জন্য স্হায়িত্বের প্রার্থনা ছাড়া আর কি'বা চাইতে পারি। আর এ চাওয়ার আগেপরে সমস্ত রাজপথ, আলপথ, গলিপথ ধরে ভূগোল আর কর্মক্ষেত্র বদলে চলেছেন পরিযায়ী সহদেব আর জহিরুলরা।

বাঙ্গুর হাসপাতাল থেকে বাঁশদ্রোণীর ২৫ মিনিটের পথ আজ মুহূর্তে শেষ হল। সহদেবের বলা গল্পের শেষ কয়েকটা লাইন এখনও ফিরে ফিরে আসছে মনে। "জীবনটা অনেক বেশি মানুষের কাজে লেগে গেল। সুস্হ বাড়ি ফেরাতে পারলাম কতজনকে! এ জীবন একাজে উৎসর্গ করতে চাই আমরা!" মহামারী কেটে যাবে একদিন। হাতে হাত রেখে এই সময়টাও গল্প হবে ভবিষ্যতে। গল্পের নির্যাসে হারিয়ে যাব আমরাও। পরে থাকবে পরিযায়ীর নিষ্ঠা আর সময়ের ছায়াছবি।

Powered by Froala Editor

Latest News See More