বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আশীর্বাদ না অভিশাপ এই নিয়ে যত চর্চাই চলুক, শেষ পর্যন্ত মেনে নিতেই হবে আজকের পৃথিবীতে প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে এক পা চলার ক্ষমতা নেই আমাদের। বর্তমান মহামারী পরিস্থিতিতে আমরা সেকথা বারবার বুঝতে পেরেছি। তবে এর মধ্যেই কলকাতা মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ যেভাবে নতুন চেহারায় খুলতে চলেছে, তা সত্যিই অবাক করার মতো। আর মহামারী পরিস্থিতি মোকাবিলায় শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে কীভাবে গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু হতে পারে, এ নিয়ে এক নতুন ভাবনার দিক খুলে দিচ্ছে ‘পথদিশা’ অ্যাপ।
১৪ সেপ্টেম্বর থেকে কলকাতা মেট্রো রেল পরিষেবা জনসাধারণের জন্য খুলে যেতে চলেছে। তবে সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং-এর চিন্তা প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পথ দেখাল প্রযুক্তিই। এই পরিস্থিতিতে থেকে মেট্রো পরিবহণের জন্য প্রয়োজন নেই কোনো স্মার্ট কার্ড বা টোকেনের। যাত্রার সময় ও নাম-পরিচয় দিয়ে ই-পাস সংগ্রহ করতে হবে রাজ্য সরকারের ‘পথদিশা’ অথবা মেট্রো কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অ্যাপ থেকে। আর এই ই-পাশের সঙ্গে থাকা কিউ-আর কোডের রং দেখেই বোঝা যাবে সেটা বৈধ কিনা। পাশাপাশি প্রতিটি রেকে থাকছে বিশেষ বোট। ইন্টারনেট পরিষেবার মাধ্যমে এই সফটওয়ার নজর রাখবে কোনো রেকে ৪০০ জনের বেশি যাত্রী উঠেছে কিনা। এমনকি বসে থাকা ও দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীর অনুপাতের উপরেও নজর রাখবে এই বোট। ফলে শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা এক্ষেত্রে কোনো সমস্যার বিষয় হবে না।
রাজ্য সরকারের পরিবহণ দপ্তরের প্রযুক্তি সহায়তা সংস্থা ‘আইডিয়েশন টেকনোলজি’-র তরফ থেকে জানানো হয়েছে, প্রথমে কিউ-আর কোড স্ক্যান করে যাত্রীদের স্টেশনে ঢোকার কথা ভাবা হয়েছিল। কিন্তু রেল রক্ষী প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যায়, এতে জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। ব্যস্ত যাত্রীদের প্রত্যেকের কিউ-আর কোড স্ক্যান করা সম্ভব নাও হতে পারে। আর সেইজন্যই প্রতি এক ঘণ্টার জন্য কিউ-আর কোডের নির্দিষ্ট রঙ ঠিক করে দেওয়া হবে। এই রঙ জানবেন শুধু মেট্রো কর্তৃপক্ষের বিশেষ অফিসাররা এবং প্রতিরক্ষা কর্মীরা।
চার বছর আগে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠে রাজ্য সরকারের ‘পথদিশা’ অ্যাপ। রাস্তায় বাসের জন্য অপেক্ষা করার দিন শেষ হয়ে গিয়েছিল তখনই। কোন বাস কোথায় আছে তার লাইভ ট্র্যাকিং-ই শুধু নয়; সেইসঙ্গে কোন বাসে কতটা ভিড়, বসার জায়গা আছে কিনা সবই জানা যাবে এই অ্যাপে। এরপর এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল ফেরি পরিবহণও। তবে শহর কলকাতার সমস্ত গণ-পরিবহণ মাধ্যমকে যুক্ত করতে গেলে মেট্রো রেলের সঙ্গে যুক্ত হতেই হয়। যদিও মেট্রো কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। করোনা পরিস্থিতিই এই যোগাযোগের রাস্তা তৈরি করে দিল।
আরও পড়ুন
রাজ্য সরকারের দেখানো পথেই ‘দিশা’ পেল কলকাতা মেট্রো
ওয়ার্ল্ড-ব্যাঙ্কের পরিবহণ বিশেষজ্ঞ রাখি বসুর মতে, “শুধুমাত্র সমস্ত ধরণের গণপরিবহণ ব্যবস্থাই নয়, সেইসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের মেলবন্ধনেরও রাস্তা খুলে দিল আধুনিক প্রযুক্তি।” কিছুদিনের মধ্যেই এই প্রকল্পের সঙ্গে সাটল কারগুলিকেও যুক্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে আরও তিন-চারটি প্রকল্প আনতে চলেছে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের প্রতিনিধি দল। “শুধু মহামারী পরিস্থিতিই নয়, আধুনিক প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে আমরা কোনোদিনই চলতে পারব না।” এমনটাই মনে করছেন রাখি বসু। ‘পথদিশা’ অ্যাপ যেভাবে সাধারণ মানুষের জনপ্রিয়তা পেয়েছে আগামী দিনে অন্যান্য প্রকল্পও একইরকম সাফল্য পাবে বলে আশাবাদী তিনি। অবশ্য এগুলি সবই বাণিজ্যিক পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত। তার মধ্যে কলকাতা বন্দরে ট্রাক পরিবহণের ক্ষেত্রেও একইরকম প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে বলে জানিয়েছেন।
সব মিলিয়ে আগামী দিনের চেহারাকে যে অনেকটাই বদলে দিতে পারে প্রযুক্তির উন্নতি, সেটা বোঝাই যাচ্ছে। আর মহামারী করোনাই যে আমাদের এই বৈপ্লবিক পরিস্থিতির মুখে দাঁড় করিয়ে দিল, সেকথা বলাই বাহুল্য।
আরও পড়ুন
১৪ সেপ্টেম্বর থেকে চালু মেট্রো পরিষেবা, সঙ্গে একগুচ্ছ নতুন নিয়ম
Powered by Froala Editor