বাড়ির উঠোনে খসে পড়েছিল তারা। তারা বলতে নক্ষত্র নয়, উল্কাপিণ্ড। তা নিয়ে রীতিমতো হইচই-ও হয়েছিল বিশ্বজুড়ে। রাতারাতি গবেষকরা এসে অতি-সন্তর্পণে সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই বহু মূল্যবান পাথর। অথচ, সেভাবে কোনো অর্থ প্রদান করা হয়নি সংশ্লিষ্ট পরিবারটিকে। তা নিয়ে খানিক গোঁসাও হয়েছিল গৃহকর্তার। ব্রিটেনের গ্লোচেস্টারশায়ারের উইঞ্চকম্বের এই ‘তারা খসার’ গল্প বছর খানেক আগে জায়গা করে নিয়েছিল ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমেও। এবার আরও একবার সাড়া ফেলল সেই ‘বিখ্যাত’ উল্কা (Meteorite)। তার সৌজন্যেই রহস্যোন্মোচন হল পৃথিবীর প্রাচীন ‘অবাক জলপান’-এর গল্প।
দীর্ঘদিন ধরেই গবেষকরা সন্দেহ করেছিলেন, কোনো বহির্জাগতিক গ্রহাণু কিংবা ধূমকেতুর খসে পড়ার ফলেই জল (Water) পেয়েছিল পৃথিবী (Earth)। তবে পাকাপাকিভাবে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি কোনো। এবার গ্লোচেস্টারশায়ারে পাওয়া উল্কাপিণ্ডটির রাসায়নিক বিশ্লেষণই সেই উত্তর দিল। গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় এবং ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের জ্যোতির্বিদ ও ভূবিজ্ঞানীরা জড়িত ছিলেন এই গবেষণার সঙ্গে। সম্প্রতি সায়েন্স অ্যাডভান্স জার্নালে প্রকাশিত তাঁদের গবেষণাপত্রটি জানাল, সবমিলিয়ে প্রায় ১১ শতাংশ জল ছিল ছোট্ট এই ‘এলিয়েন’ পাথরটিতে। ছিল ২ শতাংশ কার্বনের উপস্থিতিও।
গবেষকদের প্রেস রিলিজ অনুযায়ী, উল্কাপিণ্ডে মধ্যে পাওয়া হাইড্রোজেনের বিভিন্ন আইসোটোপের অনুপাত, পৃথিবীর মহাসাগরে প্রাপ্ত জলের প্রোটিয়াম ও ডয়টেরিয়ামের অনুপাতের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। উল্কাটির এই চরিত্রই আরও বিশেষভাবে প্রমাণ করছে, পৃথিবী জল পেয়েছিল মহাজাগতিক কোনো বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষের ফলেই।
এখানেই শেষ নয়। সিএম কার্বোনাসিয়াস কনড্রাইট নামে চিহ্নিত করা এই উল্কাপিণ্ডের মধ্যে পাওয়া গেছে অ্যামাইনো অ্যাসিডও। অর্থাৎ, গ্রহাণুর সংঘর্ষে জল ছাড়াও যে জৈবিক উপাদান পেয়েছিল পৃথিবী, মিলছে তার অস্পষ্ট ইঙ্গিতও। পাশাপাশি কসমোকেমিস্ট্রির এক অজানা অধ্যায়ও খুলে যেতে পারে এই গবেষণা থেকে, এমনটাই মনে করছেন গবেষকরা।
তবে এটাই তো প্রথম নয়, এর আগেও পৃথিবীর বুকে খসে পড়েছে একাধিক উল্কাপিণ্ড। সে-সব পাথর নিয়ে গবেষণাও কম হয়নি। তবে এই বিশেষ উল্কাটি থেকে প্রাপ্ত তথ্যকেই কেন প্রাধান্য দিচ্ছেন বিজ্ঞানীরা? আসলে এই ধরনের মহাজাগতিক পাথর পৃথিবী খসে পড়ার পরই দ্রুত বদলাতে থাকে তাদের চরিত্র। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে জল শোষণ করায় বদলে যায় তাদের রাসায়নিক গঠনও। এক্ষেত্রে উল্কাটি ভূপৃষ্ঠে খসে পড়ার কিছুক্ষণ বাদেই সংগ্রহ করা হয়েছিল তা। কাজেই, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সেভাবে বদলায়নি তার রাসায়নিক চরিত্র। বলাই বাহুল্য, প্রাথমিক পর্যায়ের পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষার ওপর নির্ভর করেই প্রকাশ করা হয়েছে সাম্প্রতিক এই গবেষণাপত্রটি। রহস্যময় এই পাথরের চরিত্র বুঝতে আরও দীর্ঘ গবেষণা চলবে বলেই জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা…
Powered by Froala Editor