“শুধুমাত্র স্যানিটারি প্যাড বা মেনস্ট্রুয়াল কাপ নিয়ে আমি বা আমার সংগঠন কাজ করে না। আমাদের আসল লক্ষ্য হল শিক্ষা। আমরা যদি আমাদের শরীরটাকে না চিনি, তার সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা না করি, তাহলে হয়তো ট্যাবু দূর করা খুব মুশকিল। সেইজন্য যখনই কোনো জায়গায় যাই, সমস্ত কিছু নিয়ে কথা বলি। যাতে আমরা না থাকলেও, মানুষদের এই ব্যাপারে জানতে বা বুঝতে কোনোরকম অসুবিধা না হয়।”
প্রহরকে বলছিলেন সঞ্জিনা গুপ্ত। আরও ভালো করে বললে, ‘রঙ্গিন খিড়কি’-র সঞ্জিনা। তাঁর জানলাগুলোও নানা রঙে সাজানো। সেখানেই সবকিছু ছাপিয়ে উঠে আসে তাঁর কাজ। দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে মেয়েদের জন্য কাজ করে চলেছেন তিনি। কেবল তাঁদের শারীরিক সমস্যা নিয়েই নয়; সঞ্জিনার চোখে উঠে এসেছে এই মেয়েদের পারিবারিক অবস্থা। একটু একটু করে যেন বেড়েছে কাজের পরিধি। আর একজন বাঙালি তরুণীর কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল একবিংশ শতকের ভারতের ‘মেনস্ট্রুয়াল’ ছবিটি…
“ছোটোবেলায় আমাকেও অনেক সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে। আর পাঁচটা মেয়ের যা হয়, তেমনটাই। আর যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে সেটাও বাকিদের থেকে আলাদা নয়। আমার নিজেরও বেশ কিছু শারীরিক সমস্যা ছিল। আর মধ্যবিত্ত পরিবারে বড়ো হয়েছি, পিরিয়ড বা স্যানিটারি প্যাড নিয়ে সেরকমভাবে কেউ কোনো কথাও বলেনি সামনে। তাই যখন বড়ো হলাম, কাজের জায়গায় এলাম, তখন নিজেই এসব নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম”, বলছিলেন সঞ্জিনা। ঠিক যেন আর পাঁচজন মেয়ের মতোই তাঁর পথচলা। যেখানে ঋতুমতী হলেই একটু ফিসফাস, মেয়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে একটু আড়াল-আবডাল রাখা। শরীর তো আমার, আর সে-জন্য সমস্যাও হবে— এটাই স্বাভাবিক। তাহলে এত গোপনীয়তা কেন? এই প্রশ্নটা বারবার সঞ্জিনার মনের মধ্যে উঠে আসে।
এবং সেই সূত্রেই কাজে নামা। ঠিক করেন, সমস্ত মেয়েদের আগে নিজেকে চেনা দরকার। “আমারই তো শরীর। আমি যদি ভালো করে না চিনি, সমস্যাগুলোকে না বুঝি, খোলামেলা না হই তাহলে আর কে বুঝবে? আর কেউ না এলে তার সমাধানও আমাদেরকেই করতে হবে।” এইভাবেই নারী স্বাস্থ্য, স্যানিটারি প্যাড ও মেনস্ট্রুয়াল কাপ নিয়ে প্রচারে নামেন সঞ্জিনা। কিন্তু এই জগতে এসে দেখেন, ছবিটা আরও আরও বড়ো পরিসরে। বাইরে থেকে দেখে যেটুকু আমরা বুঝতে পারি, সমস্যা ছড়িয়ে আছে আরও নানা জায়গায়। এবং সবগুলোই পরস্পর যুক্ত।
“কাজ করতে গিয়ে বুঝলাম, কেবল প্রোডাক্ট বা প্যাড-কাপ নিয়ে প্রচার করলে হবে না। আগে নিজেদের সমস্যাগুলোকে চিনতে হবে। একটা মেয়ে বড়ো হচ্ছে একটি পরিবারে; তারপর সে স্কুলে যাচ্ছে, একটা সমাজে বড়ো হচ্ছে, চাকরি করছে— এই সমস্ত কিছুই একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। যদি কাজ করতেই হয়, তাহলে এই সবকিছুকে নিয়েই কাজ করতে হবে। মেনস্ট্রুয়াল হেলথ নিয়ে কথা বলতে গেলে চলে আসবে গর্ভপাত, গর্ভনিরোধন, যৌন জীবনের মতো বিষয়গুলিও।” একটু একটু করে যখন কাজের ব্যাপারে বলছিলেন সঞ্জিনা, আমাদের চোখের সামনে খুলে যেতে লাগল ভারতীয় নারীদের পরিস্থিতি। খুলে গেল ভারতীয় সমাজের বর্তমান অবস্থা। সত্যিই তো, সেখানে তো কেবল পিরিয়ড, স্যানিটারি প্যাড নেই!
তাহলে কী আছে? এর উত্তরে একের পর এক তথ্য নিয়ে আসছিলেন সঞ্জিনা গুপ্ত। ২০১৪ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, গোটা ভারতের ২৩ শতাংশ মেয়েরা স্কুলছুট হয়ে যায় কেবলমাত্র পিরিয়ডের জন্য! এবং তার কারণ হিসেবে উঠে এসেছিল স্কুলে মেয়েদের বাথরুমের দুরবস্থা, পারিবারিক ইস্যু, এবং সর্বোপরি, মেনস্ট্রুয়েশন এবং মেয়েদের শরীরের সমস্যা নিয়ে তাদের কোনো ধারণাই নেই। “শুধু তাই নয়, ২০১৭ সালে তামিলনাড়ুতে একটি কিশোরী মেয়েকে তার স্কুলের শিক্ষক ব্যঙ্গ করে, খারাপ কথা বলে। কেন? না তখন মেয়েটির পিরিয়ড চলছিল, এবং তাঁর স্কার্টে দাগ লেগে গিয়েছিল। এসব আর নিতে না পেরে স্কুলের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে।” অবাক লাগছে? হ্যাঁ, এটাই ভারতের পরিস্থিতি। ভারতের ‘আধুনিক’ ছবি…
এরকম পরিস্থিতিতে সবার আগে দরকার শিক্ষা। “আমরা মেয়েরা যখন বড়ো হচ্ছি, কিশোরী থেকে আস্তে আস্তে যৌবনের দিকে যাচ্ছি, তখন আমাদের শরীরে কী কী পরিবর্তন হচ্ছে সেটা তো জানা দরকার। আর সেসব যে খারাপ কিছু না, পিরিয়ডের রক্ত যে ‘দূষিত’ নয়, এই ধারণাগুলোই সবার আগে করা দরকার। সেইজন্য আমি শুধুমাত্র স্যানিটারি প্যাড ও মেনস্ট্রুয়াল ক্যাপের সঙ্গে বাকিদের পরিচয় করাই না। সেইসঙ্গে পিরিয়ডের চার্ট, এই সবসময় কী করে শরীরের খেয়াল রাখতে হয়, কীরকম খাবার খেতে হয়, স্বাস্থ্যবিধি কী— সমস্তটাই জানানোর চেষ্টা করছি”, বলছিলেন সঞ্জিনা। বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। সেইসব করতে করতে ২০২০-র গোড়ার দিকেই শুরু করলেন নিজের সংগঠন ‘রঙ্গিন খিড়কি’। যে জানলা বন্ধ নয়; সবসময়ই খোলা। যে কেউ আসতে পারেন এখানে, সামিল হতে পারেন এই রঙিন দুনিয়ায়। আর সবার আগে আপনাকে স্বাগত জানানোর জন্য দাঁড়িয়ে আছেন সঞ্জিনা গুপ্ত।
সঞ্জিনা এবং তাঁর ‘রঙ্গিন খিড়কি’ কেবল পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতায় নয়, প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে গেছেন নিজেদের কর্মসূচি নিয়ে। রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন বিহার, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্রেও। একজন বাঙালি মেয়ে এইভাবেই এগিয়ে যাচ্ছেন নিজের রথ নিয়ে। তবে সবার আগে তিনি কাজ করছেন সমাজের পিছিয়ে থাকা মানুষদের নিয়ে। যৌনস্বাস্থ্য, পিরিয়ড ও মেয়েদের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে পৌঁছে গেছেন যৌনকর্মীদের মধ্যে। কাজ করেছেন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটির সঙ্গেও। তবে কি শুধু মেয়েরা? একদমই নয়। স্কুলপাঠ্য এবং প্রাথমিক শিক্ষা হিসেবে ছেলে-মেয়ে সবাইকেই পড়ানো উচিত। এমনকি, ছোটো ছোটো বাচ্চারা যাতে কার্টুনের মাধ্যমে এই জিনিসগুলো সহজে বুঝতে পারে, সেই প্রচেষ্টাও নেওয়া শুরু হয়েছে ‘রঙ্গিন খিরকি’র তরফ থেকে। একেবারে ছোটো বয়স থেকেই যাতে এই চর্চাটা ঢুকে যায়, যাতে আমাদের ভ্রান্ত মানসিকতার জন্য আর কাউকে বিপদে না পড়তে হয় সেটাই চান সঞ্জিনা।
“এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও প্রায় সাড়ে তিন লাখ স্যানিটারি প্যাড বিতরণ করতে পেরেছি আমরা। তবে চেষ্টা করেছি ওই মানুষরাও যাতে সচেতনতার আলো পান। আমরা হয়তো থাকব না, কিন্তু এই চর্চাটা চলতে থাকলে আমাদের সমাজেরই মঙ্গল। কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাসের বাইরে গিয়েও যাতে আমরা আমাদের শরীর নিয়ে সচেতন হই, তার সমস্যাগুলোকে বুঝি— সেজন্যই নিজেদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। শুনলে অবাক হবেন, এখনও ৮০ শতাংশ মহিলা জানেনই না ভারতে গর্ভপাত আইনত বৈধ। এই সমস্ত ইস্যুগুলো ধরেই আমরা এগোতে চাই। হয়তো খরচ হবে বলে একটি স্যানিটারি প্যাডেই বহুদিন চালাচ্ছেন অনেক মহিলা। এমন আর্থসামাজিক অবস্থা থেকেও যাতে আমরা বেরিয়ে আসতে পারি, সেটাই চাওয়া। আমরাও লড়াইয়ে আছি। আরও অনেকেই আছেন। দেখা যাক সবাই মিলে কতদূর যাওয়া যায়।”
হেসে উঠলেন সঞ্জিনা গুপ্ত। এক বাঙালি, মধ্যবিত্ত মেয়ের উত্তরণের গল্প। নিজেকে নিয়ে নয়, সবাইকে নিয়ে তাঁর পথ চলা। ভবিষ্যতের দিকে একরাশ আলো নিয়েই তাকিয়ে থাকতে চান তিনি। প্রতিবন্ধকতা অনেক। ছোটো থেকে নিজেই সেসবের সম্মুখীন হয়েছেন সঞ্জিনা। জানেন, ট্যাবু ভাঙার কাজটি এত সহজ নয়। সব জায়গায় স্যানিটারি প্যাড, মেনস্ট্রুয়াল কাপ পৌঁছে দেওয়াই আসল কাজ নয়। আসল কাজ হল সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা, সঠিক শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া। যাতে তামিলনাড়ুর মেয়েটির মতো কাউকে অকালে শেষ না হতে হয়…
Powered by Froala Editor