বাঙালির বারো মাসে তার তেরো পার্বণ। আর এই সবকিছুর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে চাঁদা। সরস্বতী পুজো হোক বা বিশ্বকর্মার আরাধনা— দলবেঁধে, একটা রসিদবই, পেন আর কিছু খুচরো নিয়ে সব জায়গায় গিয়ে চাঁদা তোলা যেন পরম্পরায় গেঁথে আছে। আর সেটাই যদি দুর্গাপূজা হয়, তাহলে তো কথাই নেই। পাড়ায় পাড়ায় রেষারেষি চরমে; এ বলে আমায় দ্যাখ তো ও বলে আমায়। কখনও কখনও জুলুমবাজির অভিযোগও আসে।
চাঁদা সংস্কৃতি কি আর আজকের? সেই কোন আদ্যিকাল থেকেই এই ব্যবস্থা চলে আসছে বাংলায়। একটা সময় যখন শুধুমাত্র বনেদি পরিবারে দুর্গাপুজোরই দহরম মহরম ছিল, তখন এই চাঁদা ব্যাপারটা সেভাবে প্রচলিত ছিল না। পরিবারের ভেতরেই পুজো যখন, তখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা জোগাড় করার প্রয়োজনটা কোথায়! সেই বনেদি পুজোই যখন বারোয়ারির চেহারা নিল, তখনই বদলে গেল দৃশ্য। সবার থেকে নির্দিষ্ট টাকা সংগ্রহ করে শুরু হল পুজোর আয়োজন। উনবিংশ শতকের কথা। ১৮৩৯ সালে একটি সংবাদপত্রে উঠে এসেছিল চাঁদার প্রসঙ্গ। হাতে গোনা কয়েকটি বারোয়ারি দুর্গাপূজার অস্তিত্ব তখন। বাড়ি বাড়ি সংগ্রহ করা তো হতই; সেইসঙ্গে শহর কলকাতার ধনী ব্যক্তিরাও সেই পুজোয় মোটা অঙ্কের চাঁদা দিতেন। এটাও একপ্রকার ক্ষমতা প্রদর্শনের জায়গা। যে বাবু যত বেশি চাঁদা দেবেন, তাঁর জোর তত। তাঁর খ্যাতিও তত। এই প্রতিযোগিতার শেষে আখেরে লাভ হত পুজো কমিটিগুলোর। প্রতিবারই মোটা অঙ্কের টাকা উঠে আসত তাঁদের হাতে। আর তা দিয়েই জাঁকজমক করে হত প্রতিমা আরাধনা। ওই বছরেই অন্য একটি খবর থেকে জানা গিয়েছিল, প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল সেই সময়ের পুজোয়!
এ তো গেল একটা দিক। তবে এসবের পাশে জুলুমবাজির নমুনাও দেখেছে বাংলা। উনবিংশ শতকে একটা প্রথাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, যে বাড়ি থেকে চাঁদা আদায় করা যাবে না, তাঁদের বাড়ির সামনে রাতের বেলায় দুর্গাপ্রতিমা ফেলে দিয়ে আসা হবে। অনেকটা কার্তিক ফেলার মতো। একবার প্রতিমা রেখে আসলে পুজো তো করতেই হবে! ধর্মপ্রাণ বাঙালির মন বলে কথা। তবে দুর্গাপুজো কি আর ছোটখাটো ব্যাপার! চাঁদার থেকে বহুগুণ বেশি খরচ হয়ে যেত ওই পরিবারগুলোর। অনেক গরীব পরিবারও নিজের সর্বস্ব খুইয়ে ফেলত এর ফলে।
তবে কিছু ক্ষেত্রে বিপদে পড়ত স্বয়ং চাঁদা আদায়কারীরা। ১৮৩২ সালের অক্টোবর মাসে ‘সমাচার দর্পণ’-এ একটি খবর বেরোয়। অকুস্থল বেলঘরিয়া। সেখানে চাঁদা না দেওয়ার ‘অপরাধে’ এক গৃহস্থের বাড়ির বাইরে এভাবেই দুর্গাপ্রতিমা ফেলে এসেছিল কয়েকজন। পরের দিন সকালে উঠেই জনৈক ব্যক্তিটি এক ঝলক দেখলেন প্রতিমাটিকে। এক মুহূর্তে মাথা গরম হয়ে গেল তাঁর। ঘরের ভেতর থেকে নিয়ে এলেন আস্ত দা। তারপর দুর্গা প্রতিমাকে টুকরো টুকরো করে কেটে ভাসিয়ে দিলেন জলে! এই দৃশ্য দেখে থ সবাই! চাঁদা আদায়কারীরাও বুঝতে পারলেন না, ঠিক কী করবেন…
তবে অনেক সময় চাঁদা জুলুমের মাত্রা সবকিছু ছাড়িয়ে যেত। রাস্তা দিয়ে যারাই যেত, তাঁদের ওপর অত্যাচার করা হত। হয় টাকা দাও, নয়তো অপমান সহ্য করো। এমনকি, মেয়েদেরও রেহাই দেওয়া হত না। কটূক্তি, অসম্মান তো লেগেই থাকত। এই ব্যাপারে একবার নাম উঠে এসেছিল বেহালার। সেখানকারই এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের কয়েকজন যুবকের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল পথচারীরা। চাঁদা আদায়ের নামে নিগ্রহ চলত। মহিলারা নিজেদের দামি গয়না খুলে রেহাই পেতেন। আর এই খবরই চলে যায় চব্বিশ পরগণার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ প্যাটনের কাছে। তাঁদের শায়েস্তা করার জন্য একবার নিজেই মহিলা সেজে পালকিতে চড়ে বসেছিলেন। যথা সময় পথ আগলে দাঁড়াল ‘চাঁদা আদায়কারীরা’। শুরু হল অত্যাচার। কতটা ধন দৌলত আছে, পরীক্ষা করার জন্য যেই না পালকির দরজা খুলল, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে এলেন প্যাটন সাহেব। শেষ পর্যন্ত দুর্বৃত্তরা ধরাও পড়েছিলেন।
তাও জুলুমবাজি বন্ধ হয়নি। আজও সেই ট্র্যাডিশন চলছে সমানে। থামেনি চাঁদা আদায়ও। আজকের করোনা পরিস্থিতিতে হয়ত একটু বুঝে শুনেই খরচা করছেন সবাই। পুজোর জাঁকজমকও এবার বেশ ম্রিয়মান। তাও, দুর্গাপূজা বলে কথা। এভাবে খালি হাতে কি ফেরানো যায় মা’কে!…
আরও পড়ুন
দুর্গার পাশেই বঙ্গবন্ধুর ছবি, ১৯৭১-এর পুজো ও এক মুসলমান ‘দেবতা’র গল্প
তথ্যসূত্র- সাবেক কলকাতার ইতিকথা/ জলধর মল্লিক
Powered by Froala Editor