হাওড়া ঘেঁষা হুগলি-র শেষ শহর উত্তরপাড়া। দক্ষিণের প্রতিবেশী বালি আর মধ্যিখানের খালটুকু পেরোলেই এক অগাধ ফারাক এই দুই শহরের। এপারে বিশ্বকর্মায় ঢেকে যায় আকাশ, ওপারে সরস্বতীতে। লোকের কথায় কান দিয়ে জেনেছি, উত্তরপাড়া নাকি কোনও একসময় অংশ হিসাবে ধরা হত বালিরই। তারপর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় একা দক্ষিণপাড়া নিয়ে টিকে রয়েছে বালি। এই গল্প থেকেই শোনা গেছে উত্তরপাড়াতেও নাকি চল ছিল সরস্বতী পুজোতেই ঘুড়ি ওড়ানোর। যদিও গত পঁচিশ বছরে ঘুড়ির যে উন্মাদনা দেখেছি বিশ্বকর্মায়, একথা হজম করে নেওয়া কঠিন।
আমাদের এক চিড় ধরা যৌথ পরিবার। একই বাড়ির বিভিন্ন তলায় বাস। রান্নাঘর আলাদা হলেও ছাদ বলতে মাথার উপরে ওই একটিই। সাকুল্যে তিন ভাইবোন আর ক্রিকেট থেকে ঘুড়ি কোনওকিছুতেই কম যাই না কেউ। একটা সময় ছিল, পাড়ার মোটে দুটি চারতলা বাড়ির একটি ছিল আমাদের। একই ছাদ থেকে উঠত প্রায় তিনজোড়া ঘুড়ি। কাকার বন্ধু, দাদার বন্ধু, আমরা সব মিলিয়ে নিজেরাই খেলতাম নিজেদের সঙ্গে। একই দোকান থেকে আসত সে ঘুড়ি, একই দোকানের মাঞ্জাও। অতএব নিজের ঘুড়ি কাটলে বুঝতাম ততটা উড়তে শিখিনি এখনও। কেবল ভালো মাঞ্জাই সব নয় এ খেলায়!
সকালে মেঘ করলে ছাদে আকাশমুখী ঝাঁটা বেঁধে দিয়ে আসত বীণাপিসি। আমাদেরও বিশ্বাস ছিল এতে কাজ হবেই। চিলেকোঠার গুমোট ঘরে টেবিল ফ্যান চালিয়ে চলত শ’খানেক ঘুড়ির কল খাটানো। দাদা দিদির পটু হাত। আমি শিখছি পাশে বসে। দুএকটা ব্যাঁকা করে ফেললে গিঁট দিয়ে ম্যানেজ করছে ওরা। একটু বাদে স্নান খাওয়া সেরে উঠে আসব আবার। সঙ্গে মাদুর, ছাতা, সানগ্লাস। মায়েরা নুনচিনির জল আর চা নিয়ে তৈরি। বাড়ির ছাদেই যেন এক একান্নবর্তী পিকনিক।
ঠাকুরদার একটি সবুজ অ্যাম্বাসাডার। তাঁকে না পেলেও তাঁর গাড়ি চড়েই বড় হয়ে গেলাম আমি। ‘ডব্লিউ এম এ ৬৩১৪’। বিশেষত্ব বলতে হ্যান্ড গিয়ার ছিল এ গাড়িতে। স্টিয়ারিং এর পাশ দিয়ে। যা এখন অনেকেই দেখেননি। সমস্যা হত এ-গাড়ির ড্রাইভার পেতে। সবাই তখন লাট্টু গিয়ারে অভ্যস্ত। একদিন রাম কাকু নিল সেই দায়িত্ব। তখন সময়টা এমনই, ড্রাইভার মানে তিনি আমাদের অভিভাবকও। বাড়ির লোকেদেরই একজন তিনি। তার বসার আলাদা ঘর ছিল বাড়িতে। হাত ধরে ঘুড়ি কিনতে নিয়ে যেত, লুকিয়ে মাঞ্জা এনে দিত আমায়। আর বিকেলে পড়াতে নিয়ে যাওয়ার একঘণ্টা আগে এসে হাজির হত, দুজনে চুপিচুপি ছাদে গিয়ে ঘুড়ি ওড়াতাম। আমাকে প্রশ্রয় দিতে দিতে ঘুড়ির নেশা ধরল রামকাকুরও। এক নিপাট শান্ত ভালোমানুষ কী প্রচণ্ড রেগে যেত আমার ঘুড়ি কেউ কাটলে। বুঝতে পারতাম কেবল মাসমাইনেতে নেই আর এই সম্পর্ক। বিকেল অনেক কাছে এনে দিয়েছে আমাদের। রামকাকু যেদিন চাকরি ছাড়ে, বয়সটা কম হলে হয়তো আমার চেয়েও বেশি কাঁদত ও।
কাকার দুই বন্ধু ছিলেন আমার নিজের কাকার সমান প্রায়, প্রদ্যুৎ কাকা আর ভোটন কাকা। চৌখস ঘুড়ির হাত দুজনের। এরা পুবে ঘুড়ে তুললে আমরা পশ্চিম কোণে গিয়ে ঠেসে থাকতাম। তারপর দাঁ-দের নারকেল গাছে ঘুড়ি ফাঁসিয়ে প্রচণ্ড রাগারাগি করতাম বড়দের উপর।
সন্ধে হয়ে যেত এদিন তাড়াতাড়ি। আসলে ভালো কিছুই খুব বেশি সময় দেয় না আমাদের। অন্ধকারে টর্চ জ্বেলে ঘুড়ি খুঁজে নামাতে হত। সারাদিনের ক্লান্তির পর জিনিস গুছিয়ে নেমে যাওয়া ঘরের দিকে। একবছর যত্নে তুলে রাখা সেসব অমূল্য ঘুড়ি-লাটাই। তারপর পরের বিশ্বকর্মা পুজোর ঠিক আগে সেসব হারিয়ে যেত কীভাবে যেন!
গত আটমাস উত্তরপাড়ায় বিকেল হতে দেখিনি। সকালে চলে আসা আর রাতে ঘুমাতে ফেরার মাঝে কোথায় যেন কালো আকাশে হারিয়ে গেছে ঘুড়ির ঝাঁক! পাড়াটা ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে গিলে নিয়েছে আপাদমস্তক। বুঝতে পারি তেমন ঘুড়ি ওড়ে না আর। সকালে ছাদে এসে পড়ে না। গাছে বা ল্যাম্পপোস্টেও ঝুলতে দেখি না। দিদি ব্যস্ত, দাদা ব্যস্ত, আমিও খানিকটা। বিশ্বকর্মা পুজোয় বাড়ি ফিরি না কেউ। প্রদ্যুৎ কাকু ভারসাম্য হারিয়েছে অনেকদিন। রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে এখন। তবু বিশ্বকর্মা ভোলেনি। প্রতিবছর এদিন বাড়িতে আসে অন্তত একবার। তারপর স্বাভাবিক কথা বলে, গল্প করে, জিজ্ঞাসাও করে না কেন ঘুড়ি ওড়াই না আর।
আজ বিশ্বকর্মা পুজো, সকাল দশটা অব্দি একটাও ঘুড়ি ছিল না আকাশে। উত্তরপাড়া কি তবে সমস্ত সন্তান হারাল? এখন দেশপ্রিয় পার্কে একটি বাড়ির বারান্দায় বসে আমি, সামনের গাছে এসে ঘুড়ি আটকাল, আমার নাগালের একটু বাইরে, নিচে একদল বাচ্চা, কেবল একটা পাতি ঘুড়ির পিছনে গত চল্লিশ মিনিট নষ্ট করল। হাতে লাটাই নেই, রাস্তা থেকে সুতো তুলে আঙুলে জড়িয়ে নিল চটপট, একটা আকাশ, একটা গোটা দিগন্ত লেপ্টে গেল ওর সর্দিমাখা হাতে। ও চাঁদ হাতে পেল। আমিও আমার শৈশব ফিরে পেলাম এই সুযোগে।
Powered by Froala Editor