কলকাতার নাইটক্লাবে আজকাল অনেকক্ষেত্রেই দেখা মেলে মহিলা বাউন্সারের। বিশেষত, নিউ ইয়ার কিংবা ক্রিসমাস ইভের সময়ে। তবে আজ থেকে দু’দশক আগের ছবি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রতিরক্ষা, বিশেষত বাউন্সারের মতো ভূমিকায় মহিলাদের কল্পনা করাও ছিল স্বপ্নাতীত। আজ থেকে বছর কুড়ি আগে, বৈষম্যের এই বেড়াজাল ভেঙেছিলেন উত্তরপ্রদেশের বছর সতেরোর এক তরুণী। মেহরুন্নিসা শওকত আলি (Mehrunnisa S. Ali)।
হ্যাঁ, উত্তরপ্রদেশের সাহারানপুর জেলার ৩৫ বছর বয়সী মেহরুন্নিসাই ভারতের সর্বপ্রথম মহিলা বাউন্সার (Woman Bouncer)। তবে খুব কিছু সহজ ছিল না তাঁর এই লড়াই। প্রথমত মহিলা, তার ওপরে প্রান্তিক গ্রামে জন্ম। ছোটো থেকেই একাধিক বিধিনিষেধের মধ্যেই বড়ো হতে হয়েছিল তাঁকে। সুযোগ জোটেনি পড়াশোনারও। বা, বলা ভালো মহিলা বলেই তাঁকে শিক্ষার গণ্ডি পেরতে দেয়নি স্বয়ং তাঁর পরিবার। স্কুলে যাওয়া তো দূরের কথা, বাড়িতে যাতে পড়াশোনা না করতে পারেন মেহরুন্নিসা, সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। কেটে দেওয়া হয়েছিল বিদ্যুতের লাইন। শুধু খাতায় কলমে স্কুলের ছাত্রীতালিকায় ছিল তাঁর নাম।
গ্রামের রীতি অনুযায়ী, ১৩ বছর বয়সেই বিবাহ ঠিক হয়ে গিয়েছিল মেহরুন্নিসার। তবে আকস্মিক টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ায় ভেস্তে যায় সেই বিয়ে। অসুস্থতা কাটিয়ে উঠে নতুন উদ্যমে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লড়াইয়ে নেমেছিলেন মেহরুন্নিসা। একপ্রকার বাড়ির অমতে গিয়েই এনসিসিতে ক্যাডেট হিসাবে যোগ দেন তিনি। শুরু হয় শরীরচর্চা।
প্রাথমিকভাবে লক্ষ্য ছিল, পুলিশের পেশাকেই জীবিকা হিসাবে বেছে নেবেন তিনি। কিন্তু চার বার চেষ্টার পরেও ব্যর্থ হন মেহরুন্নিসা। সেটা ২০০৩ সাল। তখন একাদশ শ্রেণির ছাত্রী তিনি। এনসিসি ক্যাম্পেই ভেসে আসে দিল্লিতে বাউন্সার নিয়োগের খবর। মাইনেও খারাপ না। কাউকে না জানিয়েই সেই চাকরির জন্য আবেদন করেন তিনি। উল্লেখ্য, তিনিই ছিলেন একমাত্র মহিলা আবেদনকারী। না, এবার আর ফিরতে হয়নি তাঁকে।
আরও পড়ুন
বছরভর বিনয়ের ‘অনুশীলন’, স্নেহশীল হওয়ার আর্জি ব্রিটিশ মহিলার
চাকরি জুটেছিল ঠিকই, তবে ‘বাউন্সার’-এর স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হন তিনি। কেবলমাত্র পুরুষ কর্মীদের জন্যই অলিখিতভাবে সংরক্ষিত ছিল এই তকমা। মহিলা বাউন্সারদের কেবলমাত্র ‘প্রতিরক্ষাকর্মী’ বলেই চিহ্নিত করত সংশ্লিষ্ট প্রতিরক্ষা সংস্থাটির কর্তৃপক্ষ। এই বৈষম্য এবং পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে নতুন করে লড়াই শুরু হয়েছিল তাঁর। অবশ্য মেহরুন্নিসা সরব হলেও, তাঁর আবেদনে খুব একটা কর্ণপাত করেনি কর্তৃপক্ষ। বছর কয়েক পরে নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ পেয়ে যান তিনি। সেবার উত্তরপ্রদেশে আয়োজিত হয়েছিল সঙ্গীতশিল্পী সোনু নিগমের একটি অনুষ্ঠান। পুরুষ বাউন্সারদের উপস্থিতি নিয়ে মহিলা দর্শকরা আপত্তি তোলায়, লিখিতভাবে বাউন্সারের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় তাঁর হাতে। বৈষম্যকে হারিয়ে জয়ের আলো দেখা সেই প্রথম। এরপর একাধিক খ্যাতনামা তারকার বাউন্সার হিসাবে কাজ করেছেন মেহরুন্নিসা। কাজ করেছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের বাউন্সার হিসাবেও। বর্তমানে দিল্লির একটি ক্যাফেতে কর্মরত তিনি। পাশাপাশি ফিটনেস ট্রেনারের ভূমিকাও পালন করেন ৩৫ বছর বয়সী মহিলা বাউন্সার।
আরও পড়ুন
শ্রমজীবী মহিলাদের সাম্যের লড়াই দিয়ে শুরু, ১৯০৯ সালে পালিত হয়েছিল বিশ্বের প্রথম নারী দিবস
বিগত, দেড় দশকে অনেকটাই বদলেছে দেশের সামাজিক পরিকাঠামো, পরিস্থিতি। বর্তমানে মহিলা বাউন্সারের চাহিদাও তুঙ্গে। তবে এই বৈষম্যের জাল ভাঙার নেপথ্যে কাণ্ডারি হয়েও সকলের আড়ালেই থেকে গেছেন মেহরুন্নিসা…
আরও পড়ুন
আদিবাসী চিত্রকলাকে রক্ষা করতে মহিলা শিল্পীদের সংগঠন হাজারিবাগে
Powered by Froala Editor