এই আর্টিকেলটি ল্যাপটপে টাইপ করতে পারার সিংহভাগ কৃতিত্ব তাঁর। শুধু প্রহরেরই নয়, বাংলায় বেশিরভাগ ওয়েবসাইট ও নিউজ পোর্টালের কন্টেন্টের পেছনেই টেকনিক্যাল অবদান একজন ব্যক্তির। তিনি না থাকলে, আজও হয়তো বাঙালি ডিজিট্যাল মাধ্যমে লেখালিখিকে ভয়ে দূরে সরিয়েই রাখত। যিনি প্রথম বাংলা হরফ ছাপিয়েছিলেন, বাংলা হরফের ছাঁদ তৈরি করেছিলেন যিনি প্রথম, এমনকি প্রথম বাংলা বইয়ের মুদ্রক থেকে শুরু করে বাংলা টাইপরাইটারের আবিষ্কর্তা – এই সকল কিংবদন্তিদের পাশে এক আসনে বসতেই পারেন তিনি। মেহেদী হাসান। বেশিরভাগ বাঙালি শব্দজীবীর কাছেই, আজকের দিনে ‘ডিজিটাল বিশ্বকর্মা’ এই মানুষটিই।
কিন্তু কে এই মেহেদী হাসান? নাম শুনে চট করে চিনতে পারা মুশকিল। প্রচারবিমুখ মানুষটি বিশেষ চানওনি, তাঁর নাম সামনে আসুক। বরং তাঁর সৃষ্টিকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন সবার জন্য।
ভূমিকা না করে সরাসরি বলি। বাংলাদেশের মেহেদী হাসান হলেন ‘অভ্র’-র স্রষ্টা। যে অভ্র দিয়ে আমরা বেশিরভাগ বাঙালিই বাংলা টাইপ করি। মনে আছে তো গত দশকের কথা? যখন আলাদা বাংলা কি-বোর্ড পাওয়া যেত এবং বিজয় সফটওয়্যার ইনস্টল করে বাংলা লিখতে হত? সেই লেখার যে কী খাটনি, তা হয়তো কমবেশি অনেকেই জানেন। একে তো অক্ষর খুঁজে খুঁজে টাইপ করা, তার ওপর যুক্তাক্ষরে সমস্যা – একটা সাধারণ লেখা লিখতেও পেরিয়ে যেত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অন্তত অনভ্যস্ত মানুষের কাছে বিভীষিকা ছিল সে-সময়ের ব্যবস্থা। মেহেদী সেই সমস্যারই সমাধান হিসেবে নিয়ে আসেন অভ্র। যাতে ইউনিকোড ব্যবহার করে, ফোনেটিক ল্যাঙ্গুয়েজে টাইপ করা যায়। আপনি বাংলায় যে বাক্য লিখতে চাইছেন, অভ্র চালু করে ইংরাজি হরফেই সেটা লিখলে আপনা থেকেই বাংলা হয়ে যায়।
২০০৩ সালে, ওমিক্রন ল্যাব ওয়েবসাইট থেকে অভ্র প্রথম প্রকাশ্যে আনেন মেহেদী। বিভিন্ন টেকনিক্যাল সমস্যা ও আপগ্রেডেশন পেরিয়ে, আস্তে আস্তে ব্যবহারকারীদের কাছে সহজ করে তোলেন অভ্র-কে। যখন অভ্র তৈরি করেন মেহেদী, তাঁর বয়স কত ছিল জানেন? মাত্র ১৮। প্রোগ্রামিং-এর প্রতি আকর্ষণ তাঁর দীর্ঘদিনেরই। সেই সঙ্গে বাংলা ভাষার প্রতি প্রেম তাঁকে ঠেলে দিয়েছিল এই কাজে। হ্যাঁ, ১৮ বছরের এক বাঙালি কিশোর একা তৈরি করেছিলেন অভ্র। অথচ, ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে অভ্রকে ব্যবহার করেননি কোনোদিনই। সিনিয়ররা যখন তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল অভ্র বিক্রির জন্য কত দাম নেবেন, মেহেদীর জবাব ছিল – ‘ভাষার জন্য টাকা নেব নাকি!’ তাই তাঁর অভ্র-র স্লোগান – ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’।
হ্যাঁ, মেহেদীর দৌলতেই ডিজিটাল ক্ষেত্রে আজ অনেকটাই উন্মুক্ত হয়েছে ভাষা। সাধারণ মানুষ খুব সহজেই আয়ত্ত করে নিতে পারছেন বাংলায় টাইপিং। ফেসবুক থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম, ব্লগ, ই-ম্যাগাজিন, নিউজ পোর্টাল – অভ্রের ওপর নির্ভরশীল অনেকেই। যদি মেহেদীর হাত ধরে ফোনেটিক বাংলা টাইপের সিস্টেম চালু না হত, আজও হয়তো ইংরাজি হরফে বাংলা লিখে যেতাম আমরা। কিংবা অতিকষ্টে আয়ত্ত করতাম বিজয়ের আপগ্রেডেড ভার্সন।
কিন্তু যিনি এই বিপ্লব এনে দিলেন বাংলা লেখালিখিতে, তিনি কি যথেষ্ট সম্মান পেলেন রাষ্ট্রের থেকে, মানুষের থেকে? উত্তর হল, না। ছোটখাটো কিছু স্বীকৃতি তিনি পেয়েছেন অবশ্যই। কিন্তু বড় কোনো পুরস্কার বা পদক তাঁর ভাগ্যে জোটেনি আজও। আজ তাঁর বয়স ৩৩।
আমরা যারা আমাদের মাতৃভাষা বাংলা-কে নিয়ে আবেগে ভাসি, প্রত্যেকেই কি নিজের উদ্যোগে সম্মান জানাতে পারি না তাঁকে? অন্তত কৃতজ্ঞতা তো জানানোই যায়!