করোনার পরিস্থিতি আমাদের সবাইকে ঘরবন্দি করে দিয়েছে। একটা দীর্ঘ সময়ের বিরতির পর আবারও রাস্তাঘাটে বেরোতে শুরু করেছেন মানুষ; যদিও পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। কিন্তু বিশ্বজুড়ে এই দীর্ঘ অচলাবস্থা ঠিক কীরকম প্রভাব ফেলবে সমাজে? কোভিড পরিস্থিতি, লকডাউন কী পরিবর্তন এনেছে বিভিন্ন সেক্টরে; আদৌ এনেছে কি? এই প্রশ্নগুলো বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে আমাদের মধ্যে। বিশেষ করে শিক্ষাজগত ও গণমাধ্যম কি নতুন কোনো রাস্তা খুঁজছে এর ফলে? নানা আলোচনায় বারবার ছুঁয়ে গেছে এই কথাগুলো।
মিডিয়া, শিক্ষা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই একটা জিনিস এই কদিনে বেশ জোরালোভাবে এসেছে— ডিজিটাল মাধ্যম। যেখানে পরস্পরের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হচ্ছে, সেখানে ভার্চুয়াল জগত, ওয়েব আমাদেরকে কাছে এনেছে। আগামীদিনের রাস্তা কি এটাই? এই সমস্ত কিছু নিয়েই সম্প্রতি হয়ে গেল একটি সেমিনার। উঁহু, সেমিনার নয়; ওয়েবিনার। আন্তর্জালেই চলল দশদিন ব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠান। নাম ‘মিডিয়ানেক্সট ২০২০’। আয়োজনে ছিল অ্যাডামাস বিশ্ববিদ্যালয়। সেই সঙ্গে এই উদ্যোগে অংশ নিয়েছিল সারদা বিশ্ববিদ্যালয়, বিড়লা গ্লোবাল বিশ্ববিদ্যালয়, ডিএমই (দিল্লি মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন)-সহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। দশদিন ব্যাপী এই ওয়েবিনারে এই সময়টিকেই ঘুরে ফিরে দেখার চেষ্টা করা হল। কোভিড পরবর্তী সময় ঠিক কী কী পরিবর্তন দেখতে চলেছি আমরা, ‘মিডিয়ানেক্সট’ সেই রাস্তাতেই একটু আলো ফেলার চেষ্টা করল।
দশ দিনের এই ওয়েবিনারের মূল বক্তা ছিলেন ৫৩ জন। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রথিতযশা ব্যক্তিরা বর্তমান সময়টিকে ধরলেন; নিজের মতো করে দেখার এবং দেখানোর চেষ্টা করলেন। ডিজিটাল অ্যাডভার্টাইজিং, শর্ট ফিল্ম এবং ডিজিটাল বিনোদন, ডিজিটাল যুগের সিনেমা, সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকতা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ উঠে এল এখানে। অ্যাডামাস বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আচার্য প্রফেসর সমিত রায়ের বক্তব্য অনুযায়ী, “আমরা এমন একটি দশদিনব্যাপী শিক্ষামূলক ওয়েবিনার আয়োজন করতে পেরে গর্ব অনুভব করছি। আমরা বিশ্বাস করি এই অধিবেশনের মাধ্যমে আমরা ক্লাসরুমের বাইরেও লকডাউনের সময় পড়ুয়াদের কাছে গভীর জ্ঞানভান্ডার তুলে আনতে পেরেছি । প্রতিটি সেশনই শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারা প্রত্যেকেই এ বিষয়ে উজ্জ্বল প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।”
ওয়েবিনারের প্রথম দিনেই উঠে এসেছিলেন বাংলা ও দেশের সাংবাদিকরা। উঠে এসেছিল বর্তমান সময়ের সাংবাদিকতা; বিশেষ করে ডিজিটাল জার্নালিজমের প্রসঙ্গ। ছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার ডিজিটাল সংস্করণের সম্পাদক সাংবাদিক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামন ম্যাগসেসেই পুরস্কার জয়ী লেখক পি সাইনাথ, টিভি নাইনের গ্রুপ সম্পাদক বি ভি রাও, আইবিএন ৭-এর প্রাক্তন সম্পাদক আশুতোষ, ডিএনএ-র ম্যানেজিং এডিটর অ্যান্টো টি জোসেফ প্রমুখ বিশিষ্টরা। যেহেতু ডিজিটাল জার্নালিজম, সেক্ষেত্রে এসে গেছে সোশ্যাল মিডিয়া এবং ফেক নিউজের প্রসঙ্গও। যেখান থেকে আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন বলেই বারবার জানাচ্ছেন এই সাংবাদিকরা। শুধু কোভিড পরিস্থিতিই নয়, সোশ্যাল মিডিয়া ও ডিজিটাল মাধ্যমের হাত ধরে খুব তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পড়ে খবর। এটাকেই কাজে লাগিয়ে ফেক নিউজ তৈরি করা হয়। আমরা যাতে সতর্কভাবে, যাচাই করে খবরটাকে গ্রহণ করি, সেটাই বললেন বক্তারা। এবং সেইসঙ্গে বললেন সাংবাদিকদের দায়বদ্ধতা নিয়ে।
লেখক হিসেবে তো বটেই, সাংবাদিকতার দিক থেকেও অন্যতম উজ্জ্বল একটি নাম পি সাইনাথ। তাঁর কথায় উঠে এল এখনকার সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার প্রসঙ্গ। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় ভারতের সংবাদমাধ্যমের স্থান প্রায় শেষের দিকে ছিল। বিগত কয়েক বছর ধরে নানা সময় নানা অভিযোগ উঠেছে মিডিয়াকে নিয়ে। সেই প্রসঙ্গই তুললেন সাইনাথ। তাঁর কথায়, মেইনস্ট্রিম সংবাদমাধ্যম নিজেদের দায়িত্ব থেকে কয়েক যোজন সরে এসেছে। এই মুহূর্তে দেশের আসল সমস্যাগুলো তুলে ধরছেন না তাঁরা। পরিযায়ী শ্রমিকদের দেশজোড়া দুর্দশার খবর যেভাবে মানুষের কাছে পৌঁছনো উচিত ছিল, সেইভাবে প্রথম থেকে হয়নি। বরং এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এখানেই সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন এসে যায়। ভোটের রাজনীতিই সেখানে মুখ্য হয়ে উঠছে মানুষের সমস্যার থেকে।
এভাবেই ওয়েবিনারে নিজেদের বক্তব্য ও চিন্তাধারা নিয়ে উপস্থিত ছিলেন অ্যাড ফিল্মমেকার এবং জেনেসিস ফিল্মসের প্রতিষ্ঠাতা প্রহ্লাদ কক্কর, ক্রো’স নেস্টের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট মুখার্জি, ‘শামিয়ানা’র প্রধান সাইরাস দস্তুর, জয়পুর সাহিত্য উৎসবের প্রতিষ্ঠাতা সঞ্জয় রায় প্রমুখরা। লকডাউনের পরিস্থিতিতে আমরা দেখেছি, অনেকেই নতুন করে খুঁজে নিয়েছে শিল্পকলাকে। কেউ লিখছেন, কেউ ছবি আঁকছেন, কেউ নাচছেন; কেউ বা বাড়িতে বসেই ছবি তুলছেন বা সিনেমা বানাচ্ছেন। বা নিজেই তৈরি করছেন নতুন একটি গান। এই দিকগুলোর কথাই বারবার জোর দিলেন সাইরাস দস্তুর। তাঁর কথায়, যদি এই জিনিসগুলো আমাদের সঙ্গে না থাকত, তাহলে এমন দুর্যোগে আমরা টিকতে পারতাম না। এগুলোই লড়াইয়ে সাহস দিয়েছে। কাজেই কোনো সন্তান যদি সিনেমা, গান, লেখাকে নিজের ভবিষ্যৎ হিসেবে দেখতে চায়, তবে পরিবারকে অবশ্যই তার পাশে দাঁড়ানো উচিত এবং উৎসাহ দেওয়া উচিত। তিনি এও বললেন যে, লকডাউনে শুধু ভারত নয়, বিশ্বজুড়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে দর্শকের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ফলে এটাও যে একটা ভবিষ্যৎ হতে চলেছে, তা বলাই যায়।
এভাবেই অ্যাডামাস বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ওয়েবিনার ‘মিডিয়ানেক্সট ২০২০’ আমাদের বর্তমান সময়ের একটা রূপ তুলে ধরল। নানা দিক থেকে দেখার চেষ্টা করা হল কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতিকে। যা নিঃসন্দেহে দর্শকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও শিক্ষণীয়।
Powered by Froala Editor