১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর। ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে অবশেষে আইন জারি হয়, সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ। অর্থাৎ, স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী সহমরণে গেলে তা বেআইনি বলে ঘোষিত হবে। এই আইনের বিপক্ষে গর্জে উঠলেন বাংলার হিন্দুকুলোদ্ভব অনেক ব্যক্তি। সে-তালিকায় ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলমণি দে, গোকুলনাথ মল্লিক প্রমুখ। সতীদাহের সমর্থনে প্রচুর মানুষের সই জোগাড় করে তাঁরা আইন বাতিল করার আর্জি জানালেন গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিঙ্ক-এর কাছে। অন্যদিকে রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, কালীনাথ রায় চৌধুরী, প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমুখরা এই আইনের জন্য ধন্যবাদ জানালেন গভর্নর জেনারেলকে। এসব ঐতিহাসিক তথ্য কমবেশি সকলেরই জানা। কিন্তু সতীদাহ নিয়ে তৎকালীন মিডিয়ার স্ট্যান্ড কী ছিল?
অবশ্য সে-সময় মিডিয়া বলতে এক ও অদ্বিতীয় সংবাদপত্রই। ইংরাজি ও বাংলা ভাষায়। বাংলা সংবাদপত্রগুলির মধ্যে তখন সেরা ‘সমাচার দর্পণ’। ১৮১৮ সালের ২৩ মে প্রকাশিত হয় বাংলার প্রথম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’। সম্পাদক জন ক্লার্ক মার্শম্যান। অবশ্য নামে তিনি সম্পাদক হলেও পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন বাঙালি পণ্ডিতরাই। পরের দশ-বারো বছরে একে একে এসেছে সম্বাদ কৌমুদী, সমাচার চন্দ্রিকা, বঙ্গদূত, সংবাদ প্রভাকর ইত্যাদি পত্রিকা। কিন্তু দাপিয়ে রাজত্ব করেছে সমাচার দর্পণই।
এই বিষয় শ্ৰীযুতের যদি অধৰ্ম্ম কিম্বা অশাস্ত্র বলিয়া জ্ঞান হইয়া থাকে তবে এ অধীনদিগের প্রতি অনুমতি করিলে শাস্ত্রোক্ত ষে সকল প্রমাণ ও প্রয়োগ আছে তাহা অনায়াসে দেওয়া যাইতে পারে।
এই সমাচার দর্পণে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হত সতীদাহ সম্পর্কিত নানা খবর। তাতে এর প্রতিবাদ বা সমর্থন কিছুই করা হত না, শুধু ঘটনার বর্ণনা দেওয়া হত। উনিশ শতকের বিশের দশকে সরকার নিয়ম জারি করেছিল যে, স্বামী মারা যাওয়ার সময় স্ত্রী যদি গর্ভবতী বা বালিকা হন, তাঁর সহমরণ হবে না। কিংবা, জোর করেও কাউকে সহমরণে প্রবৃত্ত করা যাবে না। প্রাপ্তবয়স্ক কেউ স্বেচ্ছায় সতী হতে চাইলে, একমাত্র সেক্ষেত্রেই সহমরণ হতে পারে। বিভিন্ন আর্টিকেলে মধ্যে এ-তথ্যও দিয়েছিল সমাচার দর্পণ।
প্রসঙ্গত, নিজস্ব এক্সক্লুসিভ খবর প্রকাশের পাশাপাশি, সমাচার দর্পণ সমসাময়িক অন্যান্য পত্রিকার আর্টিকেলও নিজেদের পত্রিকায় প্রকাশ করত। সেইসব আর্টিকেলের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হওয়াতেই কি নিজেদের পত্রিকায় ঠাঁই দিত তারা? ১৮২৯ সাল। ততদিনে জোরকদমে শুরু হয়ে গেছে ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপে সতীদাহ রদের তোড়জোড়। এমন সময়, ৮ আগস্ট ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি আর্টিকেল নিজেদের পাতায় ছাপল সমাচার দর্পণ। কী লেখা ছিল সেই আর্টিকেলে?
‘২৭ জুলাই ইণ্ডিএ গেজেট-নামক সমাচারপত্রেতে এই এক অশুভ সমাচার প্রচার হইয়াছে যে গবর্নর্মেণ্ট এইক্ষণে সহমবণ নিবারণের চেষ্টাতে আছেন এবং এতদ্দেশীয় খ্যাত এক ব্যক্তি সকল নগরবাসির প্রতিনিধি হইয়া ঐ অনুচিত বিষয়ের প্রমাণ ও প্রয়োগ লিখিয়া সমৰ্পণ করিতে স্বীকার করিয়াছেন এবং তিনি মহামহিম শ্ৰীযুত গবরনর জেনারল বাহাদুরের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন এবং শ্ৰীযুতও এই বিষয় নিবারণে নিতান্ত মানস প্রকাশ করিয়াছেন। ঐ বিষয় বিবেচনাকরণনিমিত্তে যে ধারা প্রদান করিতে অঙ্গীকার করিয়াছেন তাহা তিন প্রকার। ইহার প্রথম প্রকরণ এই যে বৰ্ত্তমান যে চলিত ধারা অর্থাৎ জোরাবরীকরা কিম্বা গর্ভবতী কিম্বা দুগ্ধপোষ্য বালক রাখিয়া সহগমন করাতে যে নিবারক আইন আছে তাহা অতিকঠিনরূপে নিযুক্ত হইবে। দ্বিতীয় প্রকরণ সুবে বাঙ্গলা ও বেহারের সরহদ্দমধ্যে এই রীতি একেবারে রহিত হইয়া যাইবে । তৃতীয় এই রাজধানীর মধ্যে বিনা কোন নিয়মে এই রীতি উঠিয়া যাইবে’।
পাঠক, খেয়াল করুন, আর্টিকেলের প্রথমেই বলে দেওয়া হচ্ছে ‘অশুভ সমাচার’। আরও বলা হচ্ছে -
'এই বিষয় শ্ৰীযুতের যদি অধৰ্ম্ম কিম্বা অশাস্ত্র বলিয়া জ্ঞান হইয়া থাকে তবে এ অধীনদিগের প্রতি অনুমতি করিলে শাস্ত্রোক্ত যে সকল প্রমাণ ও প্রয়োগ আছে তাহা অনায়াসে দেওয়া যাইতে পারে। ... যে স্ত্রীলোক পতিপ্রাণা হয় সে স্বচ্ছন্দে মনের আনন্দে ও হাস্য বদনে স্বামির জলচ্চিতায় অনায়াসে আরোহণ করে অতএব এবিষয়ে জোরাবরি ইত্যাদির সম্ভব কোনরূপে হয় না স্ত্রীলোকদিগের এ আশ্চৰ্য্য কৰ্ম্মে প্রবৃত্তিহওনের বিশেষ ফল এই আছে যে ধৰ্ম্মশাস্ত্রোক্ত যে সকল ফল আছে তম্ভোগী হন এবং লোকত আপন নাম ও কুল উজ্জল করেন। অতএব আমারদিগের ইহা নিতান্ত বিশ্বাস আছে যে দেশাধিপতি মহামহিম শ্ৰীযুত লার্ড উলিয়ম বেণ্টীঙ্ক সাহেব যিনি দুষ্টদমন শিষ্টপালন ও ধৰ্ম্ম সংস্থাপনকরণজন্য এতদ্দেশে শুভাগমন করিয়াছেন তিনি আমারদিগের চিরকালাবধি স্থাপিত যে ধৰ্ম্ম কিম্বা রীতি আছে তাহার অন্যথাকরণে কখন প্রবৃত্ত হইবেন না।’
অর্থাৎ, সতীদাহের সমর্থনে সমাচার দর্পণ এবং সমাচার চন্দ্রিকা প্রমাণও হাজির করতে রাজি। তারা এই আচারকে সমর্থনও করছে এই বলে যে, স্ত্রী-রা নিজেদের ইচ্ছাতেই সতী হন এবং নিজের নাম উজ্জ্বল করেন। ফলে, সরকার যেন এই প্রচলিত রীতি বন্ধ না করে দেয়।
স্ত্রীলোকদিগের এ আশ্চৰ্য্য কৰ্ম্মে প্রবৃত্তিহওনের বিশেষ ফল এই আছে যে ধৰ্ম্মশাস্ত্রোক্ত যে সকল ফল আছে তম্ভোগী হন
এবার আসি আরেকটি আর্টিকেলে। এটি সমাচার চন্দ্রিকা-য় প্রকাশিত হয় ৩ ডিসেম্বর। আর, সতীদাহ-বিরোধী আইন জারি হওয়ার চারদিন পর, ১২ ডিসেম্বর সমাচার দর্পণ প্রকাশ করে এটি। লেখা –
‘...লার্ড উলিয়ম বেণ্টিঙ্ক গবর্নর্ জেনরল বাহাদুর এমন নহেন যে কেহ মিথ্যা কথা বা প্রশংসাসূচক কথার দ্বারা তাহার প্রবৃত্তি জন্মাইতে পারিবেক ইহা আমরা বিশেষ জ্ঞাত আছি। যেহেতুক আমরা শুনিয়াছি শ্ৰীশ্ৰীযুতের অভিপ্রায় এই যে এ বিষয় যদি যথাশাস্ত্র না হয় তবে রহিত করিবেন আর যদ্যপি যথাশাস্ত্রসিদ্ধ হয় তবে ঐ সহগমনে যে যে কণ্টক আছে তাহাই রহিত করিবেন ইহাতেই স্পষ্ট বোধ হইতেছে শাস্ত্র বিচার না করিয়া কখন কোন আজ্ঞা দিবেন না এক্ষণে যে সকল কথা উঠিয়াছে সে গোলযোগমাত্র।
...অপর প্রায় সকল ইঙ্গরেজী কাগজেই লিখিয়া থাকেন যে এতদেশীয় অনেক হিন্দুর মত আছে কিন্তু তন্মধ্যে শ্ৰীযুত রামমোহন রায়ের নামমাত্র বাঙ্গাল হরকরায় প্রকাশ পাইয়াছে। উত্তর তিনি হিন্দুকুলোদ্ভব বটেন ইহাতে তাবৎ বা অনেক হিন্দুর মত কিপ্রকারে সম্ভবে যদি বল তাঁহার পিতৃপুরুষের বা বংশের মত ইহাতে বুঝা যাইতে পারে তাহা হইলেও অনেক বলা যায় না। উত্তর তাহাও কদাচ নহে কেননা তাঁহার পিতৃপুরুষের ও বংশের আচার ধৰ্ম্মকৰ্ম্ম যাহা তাহা অনেকে জ্ঞাত আছেন ইহার তদ্বিপরীত দেখিতে শুনিতে পাই সুতরাং তাহার মত হইলেও তাহার বংশের মত বলা যায় না।’
এই আর্টিকেলেও পরোক্ষে সতীদাহের পক্ষেই সওয়াল করা হচ্ছে এবং আশা রাখা হচ্ছে যে, শাস্ত্র বিচার করে গভর্নর জেনারেল নিশ্চয়ই পক্ষে থাকবেন। আর, রামমোহন রায়-কে ঈষৎ ঠেসও দেওয়া হচ্ছে, পারিবারিক প্রসঙ্গ টেনে এনে।
সমাচার চন্দ্রিকা-র সম্পাদক ছিলেন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি ‘ধম্মসভা’র সম্পাদক ছিলেন এবং গভর্নর জেনারেলের কাছে সতীদাহ বজায় রাখার পক্ষে আপিলও করেছিলেন। ফলে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকায় যে তাঁরই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটবে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু প্রশ্ন হল, যে সমাচার দর্পণ আগে ও পরে নিরপেক্ষ সংবাদ প্রদান করে গেছে সতীদাহ-সংক্রান্ত ব্যাপারে, তারা হঠাৎ সমাচার চন্দ্রিকার এই ‘ভিউ’ নিজেদের পাতায় ছাপাল কেন? নেহাতই অন্য মতকে ঠাঁই দেওয়া, নাকি পরোক্ষে এই প্রথাকে সমর্থন? মূল সম্পাদক একজন খ্রিস্টান মিশনারি হওয়ায়, সরাসরি সতীদাহ-কে সমর্থন করতে পারেনি বলেই কি ঘুরিয়ে অন্য পত্রিকার ভিউ ছাপা হল? সেকালের সবচেয়ে বড় বাংলা পত্রিকার এমন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
ছবি - জেমস অ্যাটকিনসন (১৮৩১)