বলিউড অভিনেতা সুশান্ত সিং রাজপুতের আচমকা আত্মহত্যার পর কেটে গেছে বেশ কয়েক মাস। কিন্তু সুশান্তের মৃত্যু রহস্য নিয়ে তরজা এখনও তুঙ্গে। সম্প্রতি অভিনেতার মৃত্যুর তদন্ত ভার গ্রহণ করেছে সিবিআই। বলিউডের নক্ষত্রখচিত বাজারে দর পায়নি যে ছেলেটা, তাকে ঘিরেই আজ উঠতে-বসতে মন্তব্য করছেন তাবড় তাবড় নেতা থেকে অভিনেতারা। অভিযোগের তীর ঘুরেছে সুশান্তের বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীর দিকেও। কিন্তু এই সব কিছুর পরেও যেভাবে অত্যন্ত মর্মান্তিক এই অধ্যায়ের সঙ্গে অপ্রত্যাশিত ভাবে জড়িয়ে রীতিমতো কদর্য আক্রমণ করা হচ্ছে বাঙালি মহিলাদের প্রতি, তা দেরিতে হলেও চোখে লেগেছে সকলেরই।
একটি জনপ্রিয় হিন্দি সংবাদমাধ্যমে তো সঞ্চালিকা এক পা এগিয়ে গিয়ে সুশান্তের উপর ‘কালা জাদু’ বা ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’-এর প্রয়োগ করেছেন রিয়া, এমন অভিযোগও দেগে দিয়েছেন রীতিমতো! সুশান্তের বোন মিতু সিংয়ের তরফেও পুলিশের কাছে জানানো অভিযোগে এই একই নিশানা করা হয়েছে রিয়া চক্রবর্তীর দিকে।
সুশান্তের মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা দেশকেই। সকলেরই দাবি ছিল যদি এই মৃত্যু স্বাভাবিক বলে না মনে হয়ে থাকে তবে তার প্রকৃত তদন্ত হোক। প্রকৃত তদন্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগে কাউকে অভিযুক্ত বলে দাগিয়ে না দেওয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে রিয়ার সঙ্গে যা হয়ে চলেছে, তাতে সভ্য দেশ হিসেবে ঠিক কতটা এগিয়ে যাচ্ছে আমরা, তা নিয়ে প্রশ্ন একটা থেকেই যায়। প্রশ্ন উঠছেও। প্রখ্যাত সাংবাদিক রাজদীপ সরদেশাই যেমন দাবি করেছেন, এই পরিস্থিতি অবাস্তব; হতবুদ্ধিকর। শুধুমাত্র টিআরপি বাড়ানোর জন্য সংবাদমাধ্যম কতটা নিচে নামতে পারে এই ঘটনা তার একটা আদর্শ উদাহরণ। সরদেশাই মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, নিউজ স্টুডিও আর আদালত কক্ষের মধ্যে যে একটা পার্থক্য আছে সেটা যেন আমরা ভুলে না যাই।
সুশান্তের মৃত্যুর তদন্তে আইনানুগ ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বারবারই সেটা জানানো হয়েছে প্রশাসন এবং আদালতের তরফে। কিন্তু আইন তো অন্য ক্ষেত্রেও আছে। এই প্রসঙ্গে একজন টুইটার ব্যবহারকারী মনে করিয়ে দিয়েছেন ২০১৩ সালে মহারাষ্ট্রে পাশ হওয়া কুসংস্কার এবং কালা জাদু বিরোধী আইনের কথা, যেখানে পরিষ্কার বলা আছে যে এই ধরনের অবাস্তব অভিযোগে কাউকে অভিযুক্ত করাই আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
কিন্তু সেইসব আইনকানুনকে গুলি মেরে রীতিমতো প্রাইম টাইমে দেখানো ওই অনুষ্ঠানে রিয়া চক্রবর্তীকে ব্ল্যাক ম্যাজিক করার দায়ে অভিযুক্ত করার পর থেকেই আরও একটি প্রবণতা ক্রমশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে নেট দুনিয়ায়। রিয়া চক্রবর্তীকে উদাহরণ করে সমস্ত বাঙালি মেয়েদেরকেই দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে এই অবাস্তব এবং কুরুচিকর অভিযোগে। সমস্ত বাঙালি মেয়েরাই আসলে ডাকিনী-যোগিনী বিদ্যার মতো কালা জাদুর মন্ত্র-তন্ত্রে পারদর্শী। তা দিয়েই পুরুষদের হাতের পুতুল বানিয়ে রাখে তারা! সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেলেদের সাবধান করে দিয়ে এরকমও লেখা দেখা গিয়েছে যে, বাঙালি মেয়েদের থেকে রীতিমতো দূরত্ব বজায় রাখা উচিত তাদের। কারণ, বাঙালি মেয়েরা জানে কী করে ছেলেদের পায়ের নিচে রাখতে হয়, কী করে ছেলেদের চাকর-বাকর বানিয়ে তাদেরকে বাড়ি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয় এবং তারপর কীভাবে ছেলেদের উপার্জন করা সমস্ত অর্থের উপর নিজের মালিকানা কায়েম করতে হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে এই মেয়েরা অগত্যা অশরীরির থেকেও ভয়াবহ হবে, তা আর নতুন কথা কী!
আরও পড়ুন
চম্বলের দুর্ধর্ষ লাখন সিং-এর চরিত্রে সুশান্ত, মনোজ বাজপেয়ী ছিলেন মানসিং-এর ভূমিকায়
এছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে একাধিক কদর্য মিম। মিমের ছবিগুলিতে ক্রমশই যেন ধরা পড়ে যাচ্ছে চোরা জাতিবিদ্বেষের ছাই চাপা নোংরা ছবিটা। রিয়া চক্রবর্তী এবং সাড়া জাগানো সিনেমা ‘গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর’-এর একটি বিশেষ দৃশ্যের ছবি পাশাপাশি রেখে লিখে দেওয়া হচ্ছে কীভাবে বাঙালি মহিলারা সব সময় বিহারি যুবকদের ক্ষতি করে এসেছে!
বস্তুত বিগত বেশ কিছু সময় ধরেই হিন্দি বলয়ের দিক থেকে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে আক্রমণ করে চলাই হচ্ছিল বাংলা বা অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষা গোষ্ঠীগুলোর উপর। বিগত কয়েক বছরে সেই প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে বই কমেনি। তবুও বলিউড সিনেমা অথবা অন্যান্য ক্ষেত্রে বাঙালি মহিলাদেরকে এইভাবে দেখানোয় খুব একটা আপত্তি আসেনি কখনোই। বাঙালিদের পরিশীলিত মননকে এর জন্য সাধুবাদ জানানোই যায়। কয়েক বছর আগে ‘ভুলভুলাইয়া’ ছবিতে বিদ্যা বালান অথবা সাম্প্রতিককালে ‘বুলবুল’-এর মতো ছবিতে অভিনেত্রী তৃপ্তি দিমরিকে দেখা গিয়েছে অতিপ্রাকৃত চরিত্রে অভিনয় করতে। কিন্তু শিল্পের স্বার্থেই এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা কখনোই যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি স্বাভাবিকভাবেই।
আরও পড়ুন
আকাশের তারার নামকরণ সুশান্তের নামে, বিরল শ্রদ্ধার্ঘ অনুরাগীর
আসলে এই ভাবে যে কোনও মহিলাদেরকে সহজ নিশানায় পরিণত করা আজন্মকাল ধরে চলে আসা পিতৃতন্ত্রের ধ্বজা উড়িয়ে আসাটাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় আবারও। তাই বাঙালি, উড়িয়া বা আসামি বলে নয়, মহিলা বলেই হয়তো এইভাবে সহজ নিশানায় পরিণত করে ফেলা যায় রিয়া চক্রবর্তীদের। ‘ডাইন’ প্রতিপন্ন করে দেওয়া যায়। পিটিয়ে মেরে ফেলা যায় কিংবা আগুনে ছুড়ে ফেলা যায়। তাই শুধু বাঙালিদের প্রতিই নয়, ভারতের অন্যান্য সকল আঞ্চলিক গোষ্ঠীগুলোর উপর থেকে এই সু-কৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া বিদ্বেষের বিষ অবিলম্বে সরিয়ে ফেলা না গেলে, আখেরে তা কিন্তু ক্ষতি করবে ভারতের ঐক্য এবং সামাজিক চেতনার অন্তর্লীন স্তরটিরই। যত তাড়াতাড়ি এই সত্য অনুধাবন করতে পারব আমরা, ততই মঙ্গল!
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
আরও পড়ুন
বর্ণ-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সুশান্ত, ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ১৫ কোটি টাকার বিজ্ঞাপনের প্রস্তাব
Powered by Froala Editor