বর্ধমানের জঙ্গলের এই দুর্গাকেই ভারতমাতা হিসেবে পূজা করতেন স্বদেশি বিপ্লবীরা

বাঙালির প্রতি ঘরে উৎসবের আমেজ। গাঁ-গঞ্জ-শহর-মহল্লায় পুজোর ঘনঘটা। পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতা, থিম-প্যান্ডেল-আলো-সাজশয্যা সব মিলিয়ে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার পালাপার্বণ এখন। একদিকে মহানগরী কোলকাতা, অন্যদিকে বর্ধমান -দুর্গাপুর হয়ে বাঁকুড়া, মেদিনীপুরের শহরে শহরে আলো ঝলমলে প্যান্ডেল, প্রতিমার রমরমার শেষ নেই। যেন অপলক চেয়ে থাকতে প্রতিটি ক্লাবের নতুন নতুন থিমকে। আর ঠিক সেইসময় এই বাংলার একেবারে দক্ষিণবঙ্গের এক প্রান্তে নিবিড় অরণ্যে, শাল-মহুয়া-পিয়ালের কোলে আনুমানিক এক হাজার বছরের ইতিহাসকে বুকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে শালবনের দুর্গোৎসব, যেখানে আজও শাস্ত্রীয় মন্ত্র উচ্চারিত হওয়ার আগে ও মন্ত্রপাঠ শেষে ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনিতে মুখরিত হয় একাকী ইতিহাস বুকে দাঁড়িয়ে থাকা গহীন অরণ্যঞ্চল।

আরও পড়ুন
দুর্গার সঙ্গে মর্ত্যে আসেন শিবও, দিন কাটান মেদিনীপুরের এই 'শ্বশুরবাড়ি'তে

পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চলে অরণ্য তেমন বিশেষ নেই তবুও বিক্ষিপ্ত কিছু জায়গায় গহীন অরণ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। বর্ধমান জেলার আউশগ্রাম ১ এবং ২ নম্বর ব্লকের অন্তর্ভুক্ত কিছু জায়গায় বেশ ভালোমতো বৃক্ষে সমারোহ অরণ্য-জঙ্গল দেখা যায়। যে অরণ্য একলা দাঁড়িয়ে থাকে কত অজানা রহস্য ইতিহাস বুকে নিয়ে। তেমনই পশ্চিম বর্ধমান জেলার গড়ের জঙ্গল সাক্ষী আছে বহু ইতিহাস, বহু যুদ্ধের। আর এই গড়ের জঙ্গলেই খোঁজ পাওয়া সেই দুর্গাপূজার, যেখানে একদা বঙ্কিমচন্দ্রের দেবীচৌধুরানী পুজো দিয়েছেন।

২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া ধ্রুব বন্দোপাধ্যায়ের পরিচালিত, আবির চ্যাটার্জি অভিনীত ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’ এবং ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দুর্গেশগড়ের গুপ্তধন; সিনেমায় যে জায়গার ইতিহাস ও অজানা রহস্যকে তুলে ধরা হয়েছে তা আসলে গড়ের জঙ্গলের কথা এবং যে রায়বাড়িকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ চলচিত্রের চিত্রপট তা আসলে কালিকাপুরের জমিদার রায় বংশের। যে কালিকাপুরের রায় বংশের দুর্গাপূজা আজও চিরনতুন। বহুকালের ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে প্রাচীন পন্থায় আজও সেই রায়বাড়ির পুজোয় বাদ্যির ঢাক আর চণ্ডীপাঠ শোনা যায়।

আর কালিকাপুরের এই রাজবাড়ি থেকে কয়েক মিনিটের লাল মাটির পথ পেরিয়ে রাজা ইছাই ঘোষের প্রতিষ্ঠিত দেউল উদ্যানের পাশ দিয়ে যেতে হয় গড়ের জঙ্গলে। আর সেই জঙ্গলের একদম মাঝখানে নিবিড় শাল-পিয়াল-সেগুনের কোলে অবস্থিত কয়েকশো বছরের প্রাচীন ঋষি মেধসের আশ্রম, যে আশ্রমেই রয়েছে রাজা সুরথের প্রতিষ্ঠিত দুর্গামন্দির ও অষ্টভুজা সিংহবাহিনী দুর্গাপ্রতিমা। শ্রী শ্রী চণ্ডীমতে রাঢ় বাংলার প্রথম দুর্গাপূজার সূচনা এই ঋষি মেধসের আশ্রম থেকেই।

লালমাটির রাস্তা পেরিয়ে গহীন অরণ্যের মাঝে শাল সেগুনের কোলে অবস্থিত এই দুর্গাপূজা ও মেধসের আশ্রম যেন কত যুগ ধয়ে বয়ে নিয়ে চলেছে ইতিহাস, বুকে গেঁথে রেখেছে কত অচেনা রহস্য, অজানা গল্প। সাঁওতাল মহল্লায় ঘেরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা গড় জঙ্গলের এই দুর্গাপূজার সূচনা হয় ধামসা-মাদলের আওয়াজে। শাস্ত্রীয় মতে ঘট আনায়নের পর থেকে মন্ত্রপাঠ শুরু হওয়ার আগে এই নিবিড় জঙ্গলে দু'একটা নাম না জানা পাখির কলরবের সাথে মুখরিত হয় 'বন্দেমাতরম’ ধ্বনি। যার কারণ খুঁজতে গেলে তাক লেগে যায়, ৪০-এর দশকে ব্রিটিশ শাসনের নির্মম অত্যাচারে বিরুদ্ধে যখন এ ভারতের বিপ্লবীরা প্রকাশ্যে অথবা গোপনে যখন বিপ্লব সূচনা করছেন, ঠিক সেই মূহুর্তে ভারতীয় বিপ্লবীদের গোপন বৈঠক ও গোপন আশ্রয়স্থলের অন্যতম জায়গা ছিল এই ঘন অরণ্যের মাঝে অবস্থিত মেধসের আশ্রম। এবং সেই বিপ্লবীরা মেধসের আশ্রমে অবস্থিত এই অষ্টভুজা সিংহবাহিনী দুর্গা প্রতিমাকে ভারতমাতা রূপে আরাধনা করতেন এবং তাঁদের আরাধনার মূলমন্ত্র ছিল ‘বন্দেমাতরম’। যদিও আজকের ভারত রাষ্ট্রে ভারতমাতার যে পরিচয়, তা বিপ্লবীদের কাছে ছিল অন্য। সেখানে হিন্দুত্বের আস্ফালন নয়, দেশের মাতৃরূপই ছিল মূল।

আজও সেই ইতিহাসকে উজ্জ্বল করে রাখতে এখানে শাস্ত্রীয় পাঠের আগে বন্দেমাতরম ধ্বনি উচ্চারিত হয়। কথিত আছে, বঙ্কিমচন্দ্রের দেবীচৌধুরানী এই মেধসের আশ্রমে দেবীকে একদা অঞ্জলি দিয়ে যেতেন। বহুযুগের যুদ্ধের গল্পকে সাক্ষী রেখে সেই আশ্রমে এখনো এক কামান-গোলা দেখা যায়। যে কামান নিঃসৃত গোলার আওয়াজে আজও সেই অঞ্চল তথা বর্ধমানের বিভিন্ন পুজোমণ্ডপে অষ্টমীর বলিদান শুরু হয়।

এই মেধাশ্রম দুর্গামন্দির থেকে কিছুটা দূরেই অবস্থিত রাজা ইছাই ঘোষের আরাধ্যা দেবী শ্যামারূপা কালীর মন্দির। জনশ্রুতি রাজা লক্ষণ সেনও এই মায়ের মন্দির নিয়মিত পুজো দিতে আসতেন। কালী পূজাতে অসংখ্য ভক্ত সমাগম হয়। কথিত আছে, এক কাপালিকের সঙ্গে নরবলির বিরুদ্ধে তরজা করে শ্রী চৈতন্যদেব এই মন্দিরে প্রথম মা-কালীর দর্শন করিয়েছিলেন, যে মায়ের এক চোখে দেখা গিয়েছিল শ্যামা অর্থাৎ কৃষ্ণ অন্য চোখে রূপা, আর সে-জন্যই এই কালী মন্দির শ্যামারূপা নামে পরিচিত।

সেখান থেকে আর কিছুটা পথ এগিয়েই রাজা ইছাই ঘোষের দেউল। ধর্মমঙ্গল কাব্যেও ইছাই ঘোষের উল্লেখ আছে। ইছাই ছিলেন গোয়ালা, স্বাধীনচেতা, বিদ্রোহী। নিজের সৈন্যদল তৈরি করেছিলেন মূলত পিছিয়ে থাকা সমাজের দুর্বলতম মানুষদের নিয়ে। যে পিছিয়ে থাকা মানুষেরা এখনো ইছাই ঘোষের স্মৃতিতে শ্রদ্ধায় নত হয়। ইতিহাস বলে, পাল রাজা নয়াপালের সময় রাজ্যের ভাঙনের সূচনা হয়। অনেক সামন্ত রাজারা বিদ্রোহ করেন, যার মধ্যে ইছাই ঘোষ অন্যতম। স্থানীয় রাজা কর্নসেনকে পরাজিত করে, বর্ধমান জেলার এক বিস্তীর্ণ অংশে গড়ে তোলেন গোপভূমি বা ঢেকুরগড়। এই অতি চমৎকার দেবালয় বা দেউলটি তৈরি করেন মাতা ভগবতীর উদ্দেশ্যে। কিন্তু এই মন্দিরটির মধ্যে একটি সুবিশাল শিবলিঙ্গ রাখা আছে বলে স্থানীয়রা একে শিব মন্দির বলেই গণ্য করে। পুরাতাত্ত্বিক মতে এটি এগারোশো শতকের। দেখতে অনেকটা ওড়িশা শিখর মন্দিরের ধাঁচের। মন্দিরটিতে পাঁচটি ধাপ দেখা যায়। তাছাড়া, বিভিন্ন সময়ে সংযুক্তি বা রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হয়েছে বোঝা যায়, আলাদাভাবে বিভিন্ন রকম ইঁটের নমুনা দেখে। অসম্ভব সুন্দর নৃত্যরতা নর্তকী এবং যক্ষমূর্তি ও টেরাকোটার অসাধারণ কাজ এই দেউলে দেখা যায়।

আসলে সেই নিবিড় অরণ্যের মাঝে যেটুকু লোকালয় থেকে বেরিয়ে এসে জীবনসংগ্রামের মাথায় কাঠের বোঝা চাপায় যে সাঁওতালি মেয়েটি, সেও আসলে এক লড়াকু দুর্গা। আর এই লড়াকু দুর্গারাই এতকাল ধরে ধামসা-মাদল বাজিয়ে অজয় নদের বাঁক ঘেঁষা গড়ের জঙ্গলের সেই ঐতিহাসিক সোনালি স্মৃতিগুলোকে যত্ন করে বাঁচিয়ে রেখেছে, বাঁচিয়ে রেখেছে মেধসের আশ্রমে অবস্থিত দেবী দুর্গাকে।        

More From Author See More