ছাত্রছাত্রী আর পর্যটকরাই ভরসা, অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান ঐতিহ্য বাঁচানোর চেষ্টায় ম্যাকলাস্কিগঞ্জ

(প্রথম পর্বের পর)

https://www.prohor.in/mccluskieganj-the-mini-london-of-india

রানা সাহেবের বাংলোটা অনেকটা জায়গাজুড়ে আছে শাল জঙ্গল। এক জঙ্গল পেরিয়ে হেঁটে চলেছি আরেক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কত রকম পাখির ডাক। মহুয়াটাঁড়ের ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলা মসৃণ, কালো, পিচ রাস্তার উপর ছড়িয়ে থাকা অভ্র সূর্যের আলো পড়ে চিক চিক করছে। আশে পাশে শাল-সেগুন-মহুয়ার মেলাই জঙ্গল। মাঝে মাঝে দু-একটা পুরনো বাংলো বাড়ি। কোনোটা ভাঙা, কোনোটা গোটা। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম একটা আধভাঙা ওয়াচ টাওয়ারের কাছে। বেশ কসরত করে উঠে ওয়াচ টাওয়ারের উপর থেকে গোটা ম্যাকলাস্কিগঞ্জ এলাকার একটা দুর্দান্ত এরিয়াল ভিউ পেলাম। এখান থেকে ম্যাকলাস্কিগঞ্জের তিনটি মূল বসতি - হেসালঙ্, লাপড়া আর কঙ্কা তিনটিই দেখা যায়।  আর দেখা যায় মহুয়াটাঁড়ের ঘন জঙ্গল এবং নাট্টা পাহাড়। ক্যামেরা লেন্স বের করে দূরের আকাশ, পাহাড়, জঙ্গল, আর নদীর চারটি স্তরের বিভিন্ন রঙের হেরফের ক্যামেরাবন্দি করতে করতে সন্ধ্যা নেমে এল।ফেরার পথ নিলাম।কাল যাব নদীর কাছে।



আরও পড়ুন
'মিনি লন্ডন অফ ইন্ডিয়া' ম্যাকলাস্কিগঞ্জের সঙ্গে জুড়ে আছে বিলিতি রূপকথাও

পরদিন সকাল সকাল ঘুম ভাঙল। জানলা দিয়ে একফালি মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে বিছানায়। বাইরের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেল 'কোয়েলের কাছে'। না না সেটা তো অন্য জায়গা। তবু এখানেও আছে অমনই ছোটো একটা নদী, চাট্টি নদী। হাঁটতে হাঁটতে পোঁছে দেখলাম তির তির করে বয়ে চলা একটা চঞ্চল নদী। আশপাশের জায়গাটা মন্দ নয়। তবে দাহ কাজ করার জন্য খানিকটা অপরিচ্ছন্ন হয়ে আছে চারপাশে চত্বর। ফেরার পথে ঢুকে পড়লাম জাগৃতি বিহারে। কাল রাতেই রানা সাহেবের কাছে এর কথা শুনছিলাম।  ১৯৭১ সালে শ্রী সচ্চিদানন্দ উপাধ্যায় ‘জাগৃতি বিহার’-এর প্রতিষ্ঠা করেন। অনেকটা আমাদের কবিগুরুর শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতনের মতো আদর্শকে সামনে রেখে প্রকৃতির মাঝে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে উঠেছে জাগৃতি বিহার। এরা স্থানীয় ওঁরাও, মুন্ডা প্রভৃতি আদিবাসীদের পড়াশুনা শেখানো বা মহিলাদের জীবিকা নির্ধারণের জন্য নানা রকম হাতের কাজ শেখানো ইত্যাদি শুরু করেন। হাতের কাজের মধ্যে, সেলাই-ফোড়াই, জামা-প্যান্ট বানানো, কাপড় বোনা, মাটির পাত্র তৈরি, ছোটখাটো কাঠের কাজ সবই ছিল। এমনকি স্থানীয় আদিবাসী যুবকদের মাদকাসক্তি থেকে মুক্ত করার জন্য এরা নানা রকম সচেতনতা মূলক উদ্যোগও শুরু করেন। যুবকদের উন্নত পদ্ধতিতে কৃষিকাজ শেখানো ও জলসেচের কাজে সাহায্য করা হয়। এর ফলে এখন সারা বছর এই অঞ্চলের মাটিতে সোনার ফসল ফলে। এছাড়াও মহিলাদের জন্য ‘স্বনিযুক্তি’ প্রকল্পের সূচনা করা হয়। কিন্তু এসব এখন অতীত। উপাধ্যায় বাবুর মৃত্যুর পর থেকে জাগৃতি বিহারের সমস্ত কাজকর্ম বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। বর্তমানে একটি সুইডিশ সংস্থা জাগৃতি বিহার-কে অধিগ্রহণ করলেও, এখনো কাজের কাজ কিছু শুরু হয়নি।

আরও পড়ুন
বকখালির ভোর, দিগন্তের হাতছানি আর পাখি চেনার মুহূর্তেরা

সকালের নাস্তা সেরে ইরশাদের গাড়ি চেপে বেড়িয়ে পড়লাম। গাড়ি পৌঁছোল ‘ডেগাডেগি’ নদীর ধারে। নদীর উপর ছোট্ট একটা ব্রিজ। ওপারে অনুচ্চ পাহাড় আর জঙ্গল। আশপাশের গাঁয়ের লোক স্নান সারতে আসে নদীতে। শান্ত সুন্দর স্বচ্ছ ডেগাডেগি এঁকে বেঁকে চলেছে। তা, নদীর এই রকম একটা অদ্ভুত নাম কেন? তার উৎস সন্ধান করতে গিয়ে জানলাম ‘ডেগাডেগি’ মানে ‘লাফালাফি’। আসলে নদীর পাড়ে পাথরের উপর কতগুলি বড়ো বড়ো গর্ত রয়েছে সেই কবে থেকে কে জানে। স্থানীয় মানুষজন মনে করে যে কোন ভূত বা অপদেবতার ‘লাফালাফি’র ফলে এরকম গর্ত সৃষ্টি হয়েছে। সেই থেকেই নদীর এই অদ্ভুত নাম, ডেগাডেগি। বেশ খানিকটা গাড়ি চলার পরে আদিবাসী গ্রামের পরে গ্রাম পেড়িয়ে তিরু ফলস। আমি এপারে পাহাড়ের মাথায় বসেই সৌন্দর্য উপোভোগ করব  মনস্থির করলাম। বাকিরা গেল ফলসটা কাছ থেকে দেখবে বলে। ফেরার পথেই রশাদ আমাদের নিয়ে চলল আরেকটি নদী দেখাতে। নদীর নাম ‘কুমারপাত্রা’। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এক আদিবাসী পল্লীর প্রান্তে গিয়ে অটো থেমে গেল। এবার পায়ে হেঁটে খানিকটা পাথুরে পথ বেয়ে নিচে নামতেই আমরা অবাক। আরে এযে বিলকুল ‘কলোরাডো’ টাইপ ভূমিরূপ। বায়ু বা নদীর ক্ষয়কার্যের ফলে পাথুরে উপত্যকায় সৃষ্টি হয়েছে এলোমেলো ‘কাটুম-কুটুম’। আর নিচ দিয়ে এঁকে বেঁকে বয়ে যাচ্ছে গাঢ় নীল কুমারপাত্রা।

গাড়ি চলছে। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কিছু রাস্তা চলার পর হঠাৎ দেখি গাছ পালার ফাঁক দিয়ে দূরে কীসের চিমনি দেখা যাচ্ছে। আর একটু এগোতেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হল। সংরক্ষিত অরণ্যের মধ্যে গাছপালা কেটে, মাটি কেটে, দূষণ ছড়িয়ে চলছে বেআইনি ইঁটভাটা। আমাদের সারথি ভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম - রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ, এমএলএ থেকে শুরু করে এদের হাত সমাজের অনেক উঁচুতলা পর্যন্ত ছড়ানো। কোরাপশান মশাই কোরাপশান। আর কিছু বছর পর এলে হয়তো দেখব এরা গোটা মহুয়াটাঁড়ের জঙ্গলটাকেই সাফ করে দিয়েছে। আবার ম্যাকলাস্কির মূল বসতিতে পৌছে, আমরা চললাম রাঁচির রাস্তায়, চামা’র দিকে। এই পথের দু পাশেই সেকালে গড়ে উঠেছিল অ্যাংলো সাহেবদের মনোরম বাংলোগুলি। যাঁর অনেকগুলিই এখনো রয়েছে। এখানেই চোখে পড়ল রোজারিও সাহেবের বাংলো, প্রাক্তন এক সেনা মেজরের বাংলো কাম হোম স্টে, বুদ্ধদেব গুহর বাংলো, অপর্ণা সেনের বাংলো, ক্লেটন সাহেবের বাংলো, স্টানলি অসওয়াল্ড পটারের বাংলো এবং সুদৃশ্য গাঙ্গুলী বাংলো। বাকি বাংলোগুলি ঘুরে দেখা গেলেও গাঙ্গুলী বাংলোর ভিতরে ঢোকা গেল না। স্বপ্নের প্রাসাদগুলো আজ এক একটা ভূতের বাড়ি। কলকাতার বাবুরা কেয়ারটেকারের কাঁধে ফেলে দিয়েছে সেকালের মিনি লন্ডনকে। 

এই অঞ্চলের বাংলো বাড়িগুলো দেখে আমরা গেলাম ৯ কিমি দূরের দুল্লি গ্রামের ‘সর্ব-ধর্ম-স্থলের’ উদ্দেশ্যে। কোনো এক মুসলমান এক পীরের কথায় এই স্থল গড়ার কাজ  শুরু করেছিলেন। শেষ হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর পরিবার উৎসাহী না হওয়াতে বেশ কিছুবছর বন্ধ পড়েছিল এটা। ২০১৩ সালে স্থানীয় সাংসদ শ্রী সুভাষকান্ত সহায় এই প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। কিছু আর্থিক সাহায্যও আসে। এক আশ্চর্য প্রকল্প। সারা ভারতবর্ষে যেখানে জাত-পাত-ধর্মের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরির চেষ্টা চলছে, সেখানে এই প্রকল্পে একই স্থানে পাশাপাশি মন্দির-মসজিদ-গুরুদ্বার এবং চার্চ স্থাপিত হয়েছে। অর্থাৎ সর্ব ধর্মের সহাবস্থান, সমন্বয়। এটাই তো হওয়া উচিৎ একটা সভ্য শিক্ষিত দেশে।

ইরশাদকে আগেই বলা ফেরার পথে দেখে যাব বক্সি বাংলো। ম্যাকলাস্কিগঞ্জের পটভূমিতে মুকুল শর্মার লেখা একটি গল্পকে ভিত্তি করেই সম্প্রতি কঙ্কনা সেনশর্মা বানিয়েছেন ‘আ ডেথ ইন দ্য গঞ্জ’। সিনেমাটা দেখার পর থেকেই আসার উন্মাদনাটা আরও বেড়ে গেছিল। ওই যে বাংলোটা দেখছেন, ওটা বক্সি বাংলো। ওই বাড়িতেই তো শ্যুটিং করলেন কঙ্কনা সেনশর্মারা। ওইখানেই বসেছিলেন ওম পুরী, রনবীর সোরে, কল্কিরা। কেয়ারটেকার এগিয়ে এলেন হাসি মুখে। বললেন, ‘‘ছোটোবেলায় দেখেছি কত বাংলা ছবির শ্যুটিং। উত্তমকুমার, অপর্ণা সেন, মুনমুন সেন সবাই এখানে এসেছেন। অনেকদিন পরে বাংলো সেজে উঠেছিল। কঙ্কনাদের ছবির সময়কাল ছিল সত্তর দশকের শেষ। তখন ম্যাকলাস্কিগঞ্জের স্বর্ণযুগ। ফিরে এসেছিল সেই সময়ের টেপ রেকর্ডার, ট্রাঙ্ককল। হঠাৎ করে যেন ওই দেড় মাস অতীতে ফিরে গিয়েছিলাম।’’

আজই শেষদিন। তাই রানা সাহেব নিজেও আমাদের সাথে এক সাথে রাতের খাবার টেবিলে বসলেন। একথা সেকথার মাঝে বলছিলেন গঞ্জের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প। ১৯৮০-৯০ পর্যন্ত যখন এক এক করে সব অ্যাংলো পরিবারগুলি গঞ্জ ছেড়ে চলে যাচ্ছে, বাকিরা দিনে দিনে আরো অসহায় হয়ে পড়ছিল। তাদের আর্থিক অবস্থাও একদম তলানিতে এসে ঠেকেছিল। না ছিল চাকরি-বাকরি না সেরকম চাষবাস। এই রকম অবস্থায় ২০০২ সালে স্থানীয় এম. এল. এ. অ্যালফ্রেড ডি. রোজারিও সাহেব ম্যাকলাস্কিগঞ্জে খুললেন “Don Bosco Academy” স্কুলের এক শাখা। রাঁচি, পাটনা, ধানবাদ প্রভৃতি দূরের শহরগুলি থেকে সম্পন্ন ঘরের ছেলেমেয়েরা এখানে পড়তে আসে। এটি একটি আবাসিক বিদ্যালয়। রোজারিও সাহেব এই বিদ্যালয়ের হোস্টেলগুলি চালানোর ভার তুলে দেন স্থানীয় অ্যাংলো পরিবারগুলিকে। প্রতিটি অ্যাংলো পরিবার অর্থের বিনিময়ে ৫০ থেকে ১০০ জন ছেলেমেয়ের থাকা খাওয়ার ভার নেয়। এর মধ্যেই আরো বেশ কিছু নামী স্কুল গড়ে ওঠে। বিভিন্ন অ্যাংলো পরিবারের শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা এই সব স্কুলে শিক্ষকতার চাকরিও পায়। আজ ম্যাকলাস্কিগঞ্জে মোট ৫৪ টি হোস্টেল। আর এই নতুন সব স্কুল এবং হোস্টেল ব্যবসাকে আঁকড়ে ধরে নতুন করে স্বপ্ন দেখছে গোটা ম্যাকলাস্কিগঞ্জ। বিভিন্ন স্কুলগুলি মিলিয়ে কম করে হলেও পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার ছাত্রছাত্রী গঞ্জে পড়ছে। এদের বিভিন্ন প্রয়োজন মেটানোর জন্য গড়ে উঠছে রাস্তা-ঘাট, দোকান-বাজার। সার্বিক একটা উন্নতির ঢেউ উঠেছে গোটা গঞ্জে। এলাকার আদিবাসীদের অনেকের জমি গেছে পাশের ই.সি.এল. এর কয়লাখনিতে। কিন্তু বিনিময়ে তারা পেয়েছে কাজ আর ক্ষতিপূরণের ভালো প্যাকেজ। গোটা গঞ্জের সঙ্গে আজ হাসছে তারাও। তাছাড়া বিগত কয়েক বছরে পর্যটকদের আনাগোনা কিছুটা হলেও  বেড়েছে। তাই কিছু মানুষ আশার আলো দেখছে।

পরদিন সকালবেলা বেড়িয়ে পড়েছি রাঁচির উদ্দেশ্য। রানা সাহেবকে বিদায় জানিয়ে আমরা গাড়িতে চড়ে বসলাম। ক্যামেরুন সাহেবের বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘হাইল্যান্ড গেস্ট হাউসের’ সামনে দিয়ে, ‘হিল টপ গার্লস হোস্টেল’কে পিছনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছি। পটার সাহেবের বাড়ির সামনে কচিকাঁচাদের ভিড়। ক্লেটন সাহেবের বাংলো থেকে কারা যেন আধভাঙা বেবি গ্র্যান্ড পিয়ানোটা বাইরে বের করেছে। পাশ দিয়ে আসতে আসতে মনে হল যেন নিখুঁত হাতের আলতো ছোঁয়ায় মোৎজার্টের সিক্সথ সিম্ফনি বাজছে। রোজারিও সাহেবের বাড়ির লন আলো ঝলমলে, অনেক যুবক-যুবতীর ভিড়, বল নাচের আসর বসেছে। গাড়ির স্পিডোমিটারের কাঁটা ৮০ ছুঁয়েছে। স্বপ্নের ম্যাকলস্কিগঞ্জের অতীত-বর্তমান সব স্লাইড শোয়ের মতো একে একে পেরিয়ে যাচ্ছে।   

কোথায় থাকবেন:

ম্যাকলাস্কিগঞ্জে থাকার জায়গা খুবই কম। উষাঞ্জলি গ্রিন মাউন্টেন হলিডে রিসর্ট (২৭৬৩৫৭/৭৭৩৯০৮৯০৫২) ডাবল বেড ৮০০ টাকা। হাইল্যান্ড গেস্টহাউস (২৭৬৫৩৯) ডাবল বেড ৭০০-৮০০ টাকা। গর্ডন গেস্ট হাউস (০৯৪৭০৯৩০২৩০) ডাবল বেড ৭০০ টাকা। ম্যাকলাস্কিগঞ্জের এসটিডি কোড ০৬৫৩১

Powered by Froala Editor