যিশুর সঙ্গে সম্পর্কহীন শ্রাউড অফ তুরিন?

শ্রাউড অফ তুরিন বা তুরিনের কাফন (Shroud Of Turin)— বিশ্বের অন্যতম রহস্যময় ধর্মীয় নিদর্শনগুলির তালিকায় প্রথম সারিতেই থাকে এই ঐতিহাসিক কাপড়ের টুকরোটি। খ্রিস্ট-ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস যিশুকে (Jesus Christ) ক্রুশবিদ্ধ করার পর, এই কাপড়ে মুড়েই সমাধিস্থ করা হয়েছিল তাঁর দেহ। সম্প্রতি এই ধর্মীয় বিশ্বাসকেই খণ্ডন করলেন নৃতত্ত্ববিদ ডেভিড অ্যাকিনসন। তাঁর দাবি, শ্রাউড অফ তুরিনের উৎস সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার সঙ্গে সরাসরি কোনো যোগাযোগই নেই যিশু খ্রিস্টের। আর তা-ই যদি হয়, তবে এই কাপড়খণ্ডের আসল রহস্য কী? আর শ্রাউড অফ তুরিনে থাকা মুখাবয়বের ছাপটিই বা কার? 

এই প্রশ্নের উত্তর পেতে ফিরে যেতে হবে মধ্যযুগীয় ব্রিটেনে। আর স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসবে হোলি গ্রেইল বা যিশুর পবিত্র পানপাত্রের প্রসঙ্গও। এই ঐতিহাসিক সামগ্রীটি রক্ষার দায়িত্ব ছিল ইউরোপের সিক্রেট সোসাইটি ‘দ্য নাইট টেম্পলার’-এর। নির্যাতনের শিকার হয়ে নাইট টেম্পলাররা ফ্রান্স থেকে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন ব্রিটেনের বার্টন-অন-ট্রেন্ট শহরে। যাঁরা ‘দ্য দা ভিঞ্চি কোড’ বইটি পড়েছেন বা সংশ্লিষ্ট চলচ্চিত্রটি দেখেছেন, তাঁরা অনেকেই পরিচিত এই ঐতিহাসিক অধ্যায়ের সঙ্গে। যাই হোক তৎকালীন সময়ে দ্য নাইট টেম্পলারের নেতৃত্বে ছিলেন রাজা ফিশার। শ্রাউড অফ তুরিন বা তুরিনের কাফন মূলত তাঁর মূর্তিকে মুড়িয়ে রাখতেই ব্যবহৃত হয়েছিল। এমনটাই দাবি জানাচ্ছেন অ্যাকিনসন। 

কিন্তু তাঁর এই দাবির পিছনে যুক্তি কী? মূলত, শ্রাউড অফ তুরিনের বিশ্লেষণে অ্যালাবাস্টার নামের বিশেষ ধরনের জিপসামের উপস্থিতির জন্যই এই দাবি অ্যাকিনসনের। মূলত এই বিশেষ পাথর ব্যবহার করেই মূর্তি নির্মাণ করতেন বার্টন শহরের মধ্যযুগীয় ভাস্কররা। কারণ, বার্টনে আলাবাস্টারের খনি থাকায় সহজলভ্য ছিল এই পাথর। তৎকালীন সময়ে পৃথিবীর অন্যত্র এই বিশেষ পাথরটির ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় না বললেই চলে। 

অ্যাকিনসনের অভিমত, অ্যালাবাস্টার পাথর দিয়েই চতুর্দশ শতকে তৈরি হয়েছিল কিং ফিশার-এর একটি প্রমাণ আয়তনের মানবমূর্তি। যা স্থাপিত হয়েছিল বার্টনের অ্যাবেতে। পরবর্তীকালে, চতুর্দশ শতকে এই ভবনটির পুনর্নির্মাণের সময় কিং ফিশারের মূর্তিটি মুড়িয়ে রাখা হয় একটি অতিসাধারণ কাপড়ের টুকরোতে। স্বাভাবিকভাবেই তাতে ছাপ থেকে যায় সেই ভঙ্গুর অ্যালাবাস্টার পাথরের মূর্তির। এখান থেকেই জন্ম ‘শ্রাউড অফ তুরিন’-এর। 

আরও পড়ুন
যিশু নন, বড়োদিনে জন্মেছিলেন সূর্যদেব— এমনটাই বিশ্বাস ছিল প্রাচীন রোমানদের

কিং ফিশারের মূর্তির সঙ্গে বাইবেলে বর্ণিত যিশু খ্রিস্টের মুখাবয়বের মিল থাকায়, তৎকালীন যাজকরা সেটিকে বিজ্ঞাপন হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন প্রচারের জন্য। এই বিশেষ কাপড়ের খণ্ড দেখতেই ভিড় জমাতেন বহু খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী মানুষ। তাতে আখেরে লাভ হত গির্জার। পরবর্তীতে ফ্লোরেন্সের কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তি এই লিনেন কাপড়ের টুকরোটি কিনে নেন। হাত ঘুরে তা এসে পৌঁছায় তুরিনে। 

আরও পড়ুন
সমপ্রেমের ছবিতে একাকার যিশু-কৃষ্ণ, কলকাতার বুকে একটুকরো প্রদর্শনী

শুধুমাত্র শ্রাউড অফ তুরিনের রাসায়নিক বিশ্লেষণই নয়, আরও একটি পৃথক গবেষণাতেও ফুটে উঠছে একই সময়কাল। অর্থাৎ, কোনোভাবেই এই কাপড়টির বয়স দু’হাজার বছর হতে পারে না। আর শ্রাউডের গায়ে লেগে থাকে রক্ত এবং অন্যান্য প্রাণীজ কোষের অস্তিত্ব? সেগুলি তবে কীসের? 

আরও পড়ুন
ম্যামথের হাড়ের স্থাপত্য থেকে যিশুর ক্রুশবিদ্ধকরণের পেরেক : ২০২০-র সেরা ১০ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার

অ্যাকিসনের তত্ত্ব অনুযায়ী, শ্রাউড অফ তুরিনের মূল কাপড়টি ছিল একটি টেবিল ক্লথ। তার ১৩ ফুট বাই ১৩ ফুট আয়তনও সেই ঘটনারই ইঙ্গিত দেয়। ফলে, তাতে উপস্থিত প্রাণীকোষ মূলত মাছ এবং অন্যান্য খাদ্যের অবশিষ্টাংশ-বিশেষ। 

যদিও এই গোটাটাই এখনও পর্যন্ত অ্যাকিনসনের তত্ত্ব। কিং ফিশারের মূর্তিটি পাওয়া গেলেই এই তত্ত্বের অকাট্য প্রমাণ মিলবে বলেই বিশ্বাস তাঁর। তাঁর অভিমত শ্রাউড অফ তুরিনের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য তৎকালীন খ্রিস্ট সন্ন্যাসীরা সরিয়ে ফেলেছিলেন বা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন ফিশারের মূর্তিটি। কারণ চতুর্দশ শতকের পর এই মূর্তিটির উল্লেখ পাওয়া যায় না কোনো নথিতেই। বার্টন অ্যাবের প্রাঙ্গণেই কোথাও সেই ঐতিহাসিক মূর্তি সমাধিস্থ করা রয়েছে বলেই বিশ্বাস অ্যাকিনসনের। যাই হোক, সেই মূর্তির সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত, যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও অ্যাকিনসনের এই তত্ত্ব কেবলমাত্র দাবিই…

Powered by Froala Editor