পরিবারের মধ্যেই গণিত নিয়ে রেষারেষি, বার্নৌলিদের সঙ্গে জড়িয়ে অদ্ভুত ইতিহাস

ভাবুন তো একবার, নিজের বাবা আপনার মেধা সহ্য করতে পারছেন না। আপনি যে মেধায় আপনার বাবার সমতুল হয়ে উঠেছেন বা তাঁকে ছাপিয়ে গেছেন; এটা তিনি মানতে পারছেন না। বাড়িতে আপনার প্রবেশ নিষেধ করেছেন। তারপর নিজেরই গবেষণাপত্র চুরি করে জার্নালে প্রকাশ করে দিলেন সাল-তারিখের জালিয়াতি করে। হ্যাঁ, এমনটাই ঘটেছিল বার্নৌলিদের খানদানি গণিত পরিবারে। 

খানদানিই বটে! নাহলে এক পরিবার থেকে আট আটজন গণিতজ্ঞ, পদার্থবিদ উঠে আসতে পারেন না, যাঁরা গণিতে এবং ফলিত গণিত বা পদার্থবিজ্ঞানে গভীর ছাপ রেখে গেছেন। সেটা কখনও  সংখ্যাতত্ত্বে ‘বার্নৌলি সংখ্যা’ হয়ে, বীজগণিতে ‘বার্নৌলি পলিনোমিয়াল’, ‘বার্নৌলি ত্রিভুজ’। কখনও বা ফ্লুইড ডাইনামিক্সের ‘বার্নৌলি প্রিন্সিপল’, ডিফারেন্সিয়াল ইক্যুয়েশনের ‘বার্নৌলি সমীকরণ’, আবার কখনও সম্ভাবনা তত্ত্ব ও রাশি বিজ্ঞানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘বার্নৌলি প্রসেস’, ‘বার্নৌলি ট্রায়াল’, বা ‘বার্নৌলি ডিস্ট্রিবিউশন’- মসৃণ করেছে আধুনিক গণিতের জয়যাত্রাকে। আদতে এইসমস্ত গাণিতিক উৎকর্ষ কোনো একজন ব্যক্তি বার্নৌলির দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। কালের নিরন্তর প্রবাহে একই পরিবারের বিভিন্ন সদস্য বিভিন্ন সময়ে এই অবদানগুলি রেখেছেন। আবার মেধার ঠোকাঠুকিতে ইগোর বিস্ফোরণ রক্তের সম্পর্ককে করেছে বিষময়।         

ডাচ বংশোদ্ভূত বার্নৌলি পরিবার ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে বেলজিয়াম থেকে চলে আসেন সুইজারল্যান্ডের বাসেলে। নিকোলাস বার্নৌলি যখন বাসেলে এলেন তখন তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত মশলা ব্যবসায়ী। তাঁর তিন সন্তান। জ্যাকব, জোহান আর এক নিকোলাস। পিতা নিকোলাস চাইলেন তাঁর সন্তানেরা দর্শন বা ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করুক। অথবা পারিবারিক মশলা ব্যবসার দায়িত্ব নিক। বড়ো ছেলে জ্যাকব জন্মগ্রহণ করেন ১৬৫৪ সালে। পিতার নির্দেশে দর্শন নিয়ে পড়াশোনা করলেও খুব দ্রুত গণিতের সৌন্দর্যে আকর্ষিত হলেন। তিনি ছিলেন লিবনিৎসের ক্যালকুলাসের মস্ত বড় সমর্থক। ‘ক্যালকুলাস অফ ভেরিয়েশন’ এর জনক বলা যায় তাঁকে। এছাড়া নেপিয়ার ধ্রুবক (বা অয়লার সংখ্যা) ‘e’ আবিষ্কারের কৃতিত্বও তাঁর। সম্ভাবনা তত্ত্বেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। ১৬৮৭ সালে বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক নিযুক্ত হন। 

জ্যাকব (১৬৫৪-১৭০৫ খ্রিঃ) 

 

জোহান (১৬৬৭-১৭৪৮ খ্রিঃ)   

 এদিকে তাঁর ছোটো ভাই জোহান কিছুদিন মশলা ব্যবসায় কাটিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানে ভর্তি হন। দাদা জ্যাকবের কাছে অঙ্ক শিখতে শুরু করেন। দুজনের প্রধান চর্চার বিষয় হয়ে উঠল গণিত। কিছুদিনের মধ্যেই ভাই জোহান গনিতে পারদর্শী হয়ে উঠলে দাদা জ্যাকবের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা শুরু করলেন। জোহান ক্যালকুলাসকে সফলভাবে ব্যবহার করে মহাকর্ষের সূত্রের ব্যাখ্যা দেন। বিশেষভাবে y=x^2 সমীকরণটি ছিল তাঁর খুব প্রিয়। দাদা জ্যাকব ভাইয়ের মেধার ঝলকানিতে মুগ্ধ হয়েও লোকসমক্ষে ভাইকে ছাত্র হিসেবে পরিচয় করাতেন। ভাইয়ের কাজকে কখনওই স্বীকৃতি দিতে চাইতেন না। জোহানকে শিক্ষার্থী বোঝাতে তাঁকে ‘তোতা পাখি’ বলে ছোটো করতেন। পরিবারে ঘনিয়ে উঠল অশান্তির কালো ধোঁয়া। সেই ধোঁয়ার আঁচ পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরে ও বিজ্ঞানী মহলে। দাদা-ভাই একে অপরের দিকে কাদা  ছেটানোয় মেতে উঠলেন। ভাইয়েরও দাদার মত বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদটিতে নজর ছিল। কিন্তু দাদার জন্য সে ইচ্ছা পূরণ হচ্ছিল না। শ্বশুরমশাইয়ের অন্তিম ইচ্ছায় জোহান হল্যান্ডের বেল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে যোগ দিতে যান। পথে জানতে পারেন দাদা জ্যাকবের মৃত্যু হয়েছে যক্ষ্মায়। ফিরে আসেন বাসেলে, যোগ দেন দাদারই পদে বাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। পরিসমাপ্তি ঘটল পারিবারিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার তিক্ত এক অঙ্কের। 

আরও পড়ুন
মদনমোহন তর্কালঙ্কারের দুর্গাপুজোয় প্রচলিত ছিল নরবলি; এখনও রয়েছে তার প্রতীক

বার্নৌলি পরিবার। মোটা হরফের নামগুলির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে গণিতের অসাধারণ সব কীর্তি 

 সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় শুরু মেধা ও সম্মানের মুকুট নিয়ে লড়াইয়ের আরেক অঙ্ক। এবার জোহানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ইর্ষার বিপরীতে তাঁর প্রতিভাবান ছেলে ড্যানিয়েল। জোহান চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে ড্যানিয়েল বড়ো ব্যবসায়ী হন। ছেলেকে বোঝান অঙ্ক পড়ে বিত্তশালী হওয়া যাবে না। কিন্তু রক্তে যাঁর গণিত, তাঁর কি ব্যবসায় মন বসে? ওদিকে বাবাও নাছোড়। ব্যবসা হল না তো কী; মেডিসিন আছে। বাবার ইচ্ছায় মেডিসিন পড়তে হল, ছেলেও শর্ত দিল বাবাকে অঙ্ক শেখাতে হবে। আ্যনাটমিতে পি.এইচ.ডি করলেন। সঙ্গে সঙ্গে বাবার কাছে গণিত চর্চাও চলতে থাকল। চিকিৎসা বিজ্ঞানে গণিতের অনুষঙ্গ জোড়েন। ব্লাড প্রেসার পরীক্ষার পদ্ধতি নির্ণয় করেন। যা প্রায় ২০০ বছর ধরে ইউরোপে অনুসৃত হয়ে এসেছে। রাশিয়ার সেন্ট পিটাসবার্গে গনিতের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ অয়লারকে সঙ্গে পান। দুজনে শব্দের কম্পন ও তরঙ্গ নিয়ে কাজ করেন। ১৭৩৪ সালে ফিরে আসেন বাসেলে।   

ড্যানিয়েল বার্নৌলি (১৭০০-১৭৮২ খ্রিঃ) 

আবার ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। প্যারিস আ্যকাডেমি আয়োজিত একটি বিজ্ঞানের বড় প্রতিযোগিতায় পিতা ও পুত্র দুজনেই আলাদাভাবে অংশগ্রহণ করলেন। দুজনেই যৌথভাবে প্রথম প্রাইজ জিতলেন। কিন্তু বাবা মন থেকে ছেলেকে সমান কৃতিত্ব দিতে রাজি হলেন না। ছেলেকে বাড়িতে ঢুকতে দিলেন না। হাইড্রোডাইনামিকসকে উন্নত করে ১৭৩৮ সালে ড্যানিয়েল ‘হাইড্রোডাইনামিকা’ গ্রন্থে ‘বার্নৌলি প্রিন্সিপল’ প্রকাশ করলেন। রেষারেষি এমন পর্যায়ে পৌঁছল; বাবা জোহান ছেলের বইয়ের নকল করে ‘হাইড্রোলিকা’ গ্রন্থ লিখলেন ১ বছর পর। কিন্তু এমনভাবে প্রকাশ করলেন যাতে মনে হয় বাবার বইটি আগে লেখা হয়েছে। পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে এহেন মেধার ঠোকাঠুকি বিজ্ঞানের ইতিহাসে বিরল।  

আরও পড়ুন
সূর্য, পৃথিবী-সহ গোটা সৌরজগতটাই সরিয়ে অন্যত্র বসাতে চেয়েছিলেন এই বিজ্ঞানী!

বিজ্ঞান চর্চায় পরম্পরা বড় কঠোর আর নির্মম। জোহানকে তাঁর কৃতকর্ম ফিরিয়ে দিল একইভাবে ছাত্র ‘এল’  হসপিটালের হাত দিয়ে। জোহানের প্রায় সমস্ত লেকচার একত্রিত করে নিজের নামে চালিয়ে দিল ‘এল’ হসপিটাল। যে বইয়ের একটি বিখ্যাত অংশ আমরা আজও ক্যালকুলাসে অনুশীলন করি ‘এল’ হসপিটালের রুল’ নামে, আদতে যা জোহানের সূত্র।                      

বার্নৌলি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ড্যানিয়েলের দুই ভাই দ্বিতীয় নিকোলাস, দ্বিতীয় জোহান ও দ্বিতীয় জোহানের দুই সন্তান দ্বিতীয় জ্যাকব ও তৃতীয় জোহান, সব মিলিয়ে কমপক্ষে আটজন বার্নৌলি গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে অনন্যসাধারণ নজির রেখেছেন। আর নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বৈরিতা, ইর্ষা, প্রতারণা পারিবারিক সম্পর্ককে করেছে মেধার কষ্টি পাথরে যাচাই। রক্তের সম্পর্কের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে বিষাক্ত করেছে ইগোর অহমিকা। সবশেষে জয়ী হয়েছে গণিত তথা বিজ্ঞান। সমৃদ্ধ হয়েছে মানব সভ্যতা।

 

আরও পড়ুন
দুঃস্বপ্নে হানা হিটলারের, যৌথ গবেষণায় ভাঙন; নোবেলই মিলিয়ে দিল দুই বিজ্ঞানীকে

Powered by Froala Editor

Latest News See More