কারখানার দরজা খোলা। কিন্তু ধূধূ শূন্যতা অন্তরমহলে। চলছে না যন্ত্রপাতি। বরং, গেটের বাইরে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত। বা বলা ভালো, গড়ে উঠেছে মানব-ব্যারিকেড। হাতে প্ল্যাকার্ড, পোস্টার নিয়ে গর্জে উঠছেন তাঁরা। হ্যাঁ, তাঁরা কারখানার শ্রমিক। গোটা মার্কিন মুলুকের ছবি এখন এমনটাই। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে এভাবেই স্বতন্ত্র স্বর খুঁজে নিয়েছেন মার্কিন শ্রমিকরা (US Workers)। গোটা দেশ যেন ডাক দিয়েছে গণ ধর্মঘটের (Mass Strike)।
গত ১৪ তারিখের কথা। প্রথম ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন জন ডিয়ার কোম্পানির প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক। শ্রমিকদের মজুরি এবং অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির দাবি নিয়ে এই ধর্মঘট। ঠিক তার পরেরদিনই তাঁদের অনুসরণ করেন কেলগস কোম্পানির আরও ১৪০০ শ্রমিক। তারপর থেকে একে একে বেড়েই চলেছে সাময়িকভাবে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া কর্মক্ষেত্রের সংখ্যা। তবে সবচেয়ে বড়ো আঘাত আসে শনিবার রাতে। এদিন একইসঙ্গে প্রায় ৬০ হাজার হলিউড কর্মী ২ দিনের জন্য ধর্মঘট ঘোষণা করেন।
তবে এখানেই শেষ নয়, আগাম হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন স্বাস্থকর্মীরাও। বেসরকারি সংস্থা কায়জার নিয়ন্ত্রিত প্রায় ১৪টি হাসপাতালের ৩২ হাজার নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীও এই ধর্মঘটে যোগ দিতে পারে কয়েকদিনের মধ্যেই। সরাসরি কাজ বন্ধ করে না দিলেও, প্রতিবাদে সরব হয়েছেন বিমানকর্মীরাও।
উল্লেখ্য, বিগত ১৪ বছরের ইতিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড়ো জাতীয় পর্যায়ের ধর্মঘট। শুধু শ্রমিক ইউনিয়নগুলির ধর্মঘটই নয়, কর্মক্ষেত্রের প্রতি বিতৃষ্ণা থেকে কাজ ছেড়েছেন ইউনিয়ন বহির্ভূত লক্ষ লক্ষ মার্কিন শ্রমিক। শুধুমাত্র আগস্টের হিসাবই বলছে, কাজ ছেড়েছেন ৪৩ লক্ষ মানুষ। যাঁদের মধ্যে ৮ লক্ষ মানুষ সম্পূর্ণ বেকার হওয়া সত্ত্বেও ছেড়েছেন কর্মক্ষেত্র। যা ২০০৯-এর গ্রেট রিসেসনের পর এখনও পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এখন প্রশ্ন থেকে যায়, হঠাৎ এই গণ-বিক্ষোভের কারণ কী?
আরও পড়ুন
স্বপ্ন থামতে দেননি শ্রমিক দিদা, দারিদ্রকে হারিয়ে অলিম্পিকে নাতনি রেবতী
এক কথায় বলতে গেলে কর্পোরেট দুনিয়া এবং পুঁজিবাদের প্রতি হতাশ হয়েই গণ-আন্দোলনের পথে হাঁটছেন মার্কিন কর্মীরা। সামগ্রিকভাবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি হলেও, সেইভাবে বেতন বাড়েনি কর্মীদের। বদলে, যুক্তরাষ্ট্রে লাফিয়ে বেড়েছে বিলিয়নেয়ার এবং মিলিয়নেয়ারের সংখ্যা। সেখান থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, পুঁজিবাদীদের দৌরাত্ম্যে অর্থনীতির স্রোতই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। সেইসঙ্গে লকডাউন-পরবর্তী সময়ে, বাজারে চাহিদা বাড়ায় হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পেয়েছে কাজের চাপও। বাড়তি সময় কাজ করার পাশাপাশি কমেছে শ্রমিকদের দৈনিক জীবনযাপনের মানও। মহামারীর আবহে অর্থনৈতিক মন্দার দোহাই দিয়ে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে তাঁদের। আর এইসব ঘটনার যৌথ প্রভাবেই গণ-ধর্মঘটের কর্মসূচি নিয়েছেন মার্কিন শ্রমিকরা।
আরও পড়ুন
প্যারোডিকে অস্ত্র করেই করোনা-যুদ্ধে সামিল ঝাড়খণ্ডের শ্রমিক
অন্যদিকে দেখতে গেলে সরকারি কর্মক্ষেত্রে এই হতাশা বা বিক্ষোভের মাত্রা সামান্যই। সেখান থেকেই উঠে আসছে আরও একটি প্রশ্ন। তবে কি বেসরকারিকরণ কিংবা বেসরকারি সংস্থার বাড়বাড়ন্তই ক্রমশ সংকটময় করে তুলছে শ্রমিকদের অস্তিত্বকে? জানা নেই সেই প্রশ্নের উত্তর। এখনও পর্যন্ত মাত্র ৪০ হাজার শ্রমিকের ইউনিয়নের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মক্ষেত্রের কর্তৃপক্ষরা। তবে সোমবারের মধ্যে তাঁদের দাবি মানা না হলে, আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে এই গণ-বিক্ষোভ, তা জানিয়ে রেখেছে ইউনিয়নগুলি। এর বাইরে এখনও লক্ষাধিক কর্মীর সঙ্গে কোনোরকম আলোচনাই করেনি কারখানা কর্তৃপক্ষ। সার্বিকভাবে এই ধর্মঘট চলতে থাকলে মার্কিন অর্থনীতি বড়োসড়ো ধাক্কা খেতে চলেছে আগামী দিনে, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। এখন দেখার, ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকা এই পরিস্থিতিকে আয়ত্তে আনতে বাইডেন প্রশাসন কোনো উদ্যোগ নেয় কিনা…
আরও পড়ুন
পরিযায়ী শ্রমিকের সন্তানদের জন্য স্কুল বেঙ্গালুরুর পুলিশকর্মীর
Powered by Froala Editor