‘মাসান’— রাধা-কৃষ্ণের বদলে শিব-পার্বতীকে কেন্দ্র করেই হোলির উদযাপন বেনারসে

‘মাসান’। নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বারানসীর ছবি— মণিকর্ণিকা, গঙ্গার ঘাট, রেলব্রিজের ওপর দিয়ে ছুটে যাওয়া আলোকরেখা। ভিকি কৌশল, শ্বেতা ত্রিপাঠী, রিচা চাড্ডার মুখ— জীবনের ভাঙা-গড়ার গল্প। তবে শুধু সিনেমার সূত্রেই নয়, বেনারসের সঙ্গে ‘মাসান’ শব্দটির সাংস্কৃতিক যোগও বেশ নিবিড়। ‘মাসান’ সেখানকার একটি হোলি বিশেষ। 

তবে আমাদের প্রচলিত হোলির সঙ্গে এই উৎসবের মিল খুঁজতে যাওয়া একটু বোকামিই হবে বৈকি। ‘মাসান’ (Masan Holi) জীবনের, ভালোবাসার উদযাপন নয়। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম নেই সেখানে। বালাই নেই লাল-নীল-সবুজ-হলুদ আবিরের। বরং, ‘মাসান’-এর সময় ধূসর থেকে ধূসরতর হয়ে ওঠে বারানসী। হয়ে ওঠে ভয়াল। 

একটু খুলে বলা যাক বিষয়টা। ‘মাসান হোলি’ সাধু-সন্ন্যাসী, মূলত অঘোরীদের উৎসব। তাই কৃত্রিম কিংবা আয়ুর্বেদিক রং-আবির নয়, বরং ছাইভস্ম দিয়েই হোলি খেলেন তাঁরা। তাও যে-সে ছাই নয়, খোদ মণিকর্ণিকায় জ্বলতে থাকা মৃতদেহের চিতাভস্ম। একদিকে যেমন এদিন বারানসীর আকাশে উড়তে থাকে ধূসর ছাই-এর ধুলো, তেমনই গোটা এলাকা গম গম করতে থাকে শিবভক্ত অঘোরীদের ‘ব্যোম ভোলে’-রব, ডম্বরু-ধ্বনি, মহাদেবের জয়ধ্বনিতে। গঞ্জিকার গন্ধে ম’-ম’ করে আকাশ-বাতাস। ছোটে ভাঙের ফোয়ারা। যুগের পর যুগ ধরে এই রীতি চলে আসছে মণিকর্ণিকা ঘাটে। কিন্তু এমন আশ্চর্য হোলি উদযাপনের কারণ কী?

এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে শাস্ত্রে। পুরাণ বলছে শিবরাত্রীর দিন পার্বতীকে বিবাহ করেছিলেন শিব। এরপর সপ্তাহ দুয়েক শ্বশুরবাড়িতে কাটানোর পর, রংভরি একাদশীতে কাশীতে পা রাখেন শিব-পার্বতী। দেবাদিদেবের সস্ত্রীক কাশী আগমনকে কেন্দ্র করেই সেদিন উৎসবে মেতেছিলেন বেনারসের শিবভক্তরা। পরদিন মণিকর্ণিকার ঘাটে চিতাভস্ম গায়ে মেখে হয়েছিল উৎসবের উদযাপন। হাজির ছিলেন স্বয়ং দেবাদিদেবও। কাজেই দিনটি শ্মশানবাসী, শিবভক্ত অঘোরীদের কাছে বিশেষ পবিত্রদিন। তাই বছর বছর ছাই মেখে ‘মাসান’ পালন করেন তাঁরা। মজার বিষয় হল, ক্যালেন্ডারের পাতায় দেখতে গেলে ‘মাসান’ পালিত হয় দোল পূর্ণিমার ঠিক দু’দিন আগে। এও যেন এক অদ্ভুত সমাপতন। 

একটা সময় কেবলমাত্র অঘোরী ও সাধু-সন্ন্যাসীরাই অংশ নিতেন এই উৎসবে। তবে ধীরে ধীরে এই উৎসব সার্বজনীন হয়ে উঠেছে বেনারসে। আজ সেখানে অংশ নেন সাধারণ মানুষও। সাধুসন্তদের জন্য আয়োজন করা হয় পানীয়ের। এই ভয়াল হোলি-খেলা দেখতে হাজির হন দেশ-বিদেশের পর্যটকরাও। চলতি বছরেও তার অন্যথা হয়নি। ‘মাসান’ উদযাপন দেখতে হাজির হয়েছিলেন ৫০ হাজার মানুষ। বেনারসের কীনারাম আশ্রম থেকে বিশেষ শোভাযাত্রা আয়োজিত হয়েছিল অঘোরীদের। বেনারসের বিভিন্ন ঘাট ঘুরে এই যাত্রা শেষ হয় হরিশচন্দ্র ঘাটে। এমন বিচিত্র হোলি উৎসব আর অন্য কোথাও দেখা যায় না সম্ভবত…

Powered by Froala Editor

More From Author See More