পালাতে হয়েছিল নিজের বাড়ি থেকেও, দিনে-দিনে প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের 'মসীহা' মার্শা

আত্মীয়দের সঙ্গে সে এসেছিল শহরে। গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে তাঁরা বলেছিলেন মিনিট দশেক অপেক্ষা করতে। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও হদিশ নেই তাঁদের। তবে লুকিয়ে দিদার জামাকাপড় আর মহিলাদের মেক-আপ পরার জন্যই এমন শাস্তি? কিন্তু তার থেকেও বড়ো কথা, এই অজানা শহরে কোথায় যাবে এখন বছর এগারোর ছোট্ট শিশু? তার কণ্ঠস্বর শুনেও যে এড়িয়ে যাচ্ছে পথচলতি সকলেই। শেষ অবধি খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণীর দ্বারস্থ হল সে। বয়সে বড়ো জোর বছর ছয়েকের বড়ো। সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে শান্তভাবেই তিনি জানিয়ে দিলেন, আত্মীয়েরা আর নিতে আসবে না তাকে। তবে চাইলে তাঁর সঙ্গেই সে থাকতে পারে, সেই ভরসাও দিলেন তিনি। 

১৯৬৩ সাল। নিউইয়র্কের গ্রিনউইচে ঠিক এভাবেই আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন সিলভিয়া রিভেরা। আর আশ্রয়দাতা? মার্শা পি জনসন। দুটি নামই অনেকের কাছে পরিচিত। ১৯৬৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুকে আগুন মতো ছড়িয়ে পড়েছিল এলজিবিটি আন্দোলন। আর সেই আন্দোলনেরই অন্যতম দুই শরিক ছিলেন মার্শা এবং সিলভিয়া। প্রবাদপ্রতিম এই দুই ব্যক্তিত্ব সহকর্মী ও বন্ধু হিসাবে পরিচিত হলেও¸ পারতপক্ষে সন্তানস্নেহে সিলভিয়াকে বড়ো করেছিলেন মার্শা। বুঝতে দেননি মায়ের অভাব।

আসলে তাঁর গল্পও যে হুবহু মিলে যায় সিলভিয়ার সঙ্গে। একেবারে ছোটোবেলাতেই মার্শা বুঝে গিয়েছিলেন পরিচয়পত্রে পুরুষ হলেও, আর পাঁচটা ছেলের মতো নন তিনি। আর সেই কারণেই যে রাত-দিন বাড়িতে লেগে থাকত অশান্তি। সঙ্গে পাড়া-প্রতিবেশীদের গঞ্জনা, তীর্যক কথা তো ছিলই। কিন্তু কতদিন এভাবে অপমান সহ্য করা যায়? স্কুলের গণ্ডি পেরনোর পরেই বাড়ি ছাড়লেন তিনি। সঙ্গে কিছু জামাকাপড় আর মাত্র ১৫ ডলার অর্থ। নতুন ঠিকানা হল নিউ ইয়র্কের গ্রিনউইচ ভিলেজ। কিন্তু কে কাজ দেবে তাঁকে? একে তিনি কৃষ্ণাঙ্গ, তার ওপরে রূপান্তরকামী। আর প্রান্তিক যৌনতার মানুষদের যে, কোনো কাজই নেই যুক্তরাষ্ট্রে। তাঁদের তখন রাখা হয়েছে নিষিদ্ধ গোষ্ঠীর মধ্যেই। ফলত, তিনি বেছে নিয়েছিলেন যৌনকর্মীর পেশা। ম্যালকম মাইকেল জুনিয়র থেকে হয়ে উঠেছিলেন মার্শা পি জনসন। 

ষাটের দশকের সেই সময়টায় আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে হিংসার শিকার হচ্ছেন সমকামী মানুষেরা। সমকামী বলতে অবশ্য সেসময় সমস্ত প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষদেরই বোঝানো হত। আসলে তখনও পর্যন্ত প্রচলিত হয়নি রূপান্তরকামী বা ট্রান্সজেন্ডার কথাটি। যাই হোক সেই হিংসার প্রকোপ থেকে খানিকটা হলেও মুক্ত ছিল গ্রিনউইচ। এক কথায় প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার আশ্রয়কেন্দ্র ছিল এই শহর। 

তবে সেখানেও আছড়ে পড়ল হিংসার আগুন। ১৯৬৯ সাল। ২৮ জুন রাতেই নিউইয়র্ক পুলিশ হানা দিল স্টোনওয়াল ইন বারে। প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়েই সমকামীদের বার করে দেওয়া হল রাস্তায়। তারপর শুরু হল নির্যাতন। না, চুপ করে থাকতে পারেননি তাঁরা। সমকামীরা তো বটেই, পাশাপাশি স্থানীয়রাও সামিল হলেন প্রতিবাদে। আর গোটা পরিস্থিতিটাই বদলে গেল ভয়ঙ্কর একটি দাঙ্গায়।

ঘটনার খবর পেয়ে স্টোনওয়ালে ছুটে এলেন মার্শা। ততক্ষণে যা দক্ষযজ্ঞ হওয়ার হয়ে গেছে। কিন্তু এই হিংসার যে স্থায়ী সমাধান দরকার। আর তার জন্য দরকার দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলনের। সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে যে গুটিকয় মানুষ এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যেই ছিল মার্শার নাম। ঠিক পরে বছরই ২৮ জুনের দাঙ্গার স্মরণে জুন মাসে আমেরিকায় পথে নামেন হাজার হাজার সমকামী মানুষ। প্রথমবারের জন্য ‘প্রাইড ওয়াক’-এর সাক্ষী হয় বিশ্ব। সেখানেও নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন মার্শা। তবে শুধু সমকামী আন্দোলনই নয়, রূপান্তরকামী এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের বৈধ পরিচয়প্রাপ্তির জন্য পৃথকভাবে আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। তিনিই প্রথম ব্যবহার করেন ‘ট্রান্সভেস্টিট’ কথাটি। পরবর্তীতে সেখান থেকে জন্ম নেয় ‘ট্রান্সজেন্ডার’ শব্দবন্ধ।

কিন্তু শুধুমাত্র সরকারের কাছে আবেদন করেই যে এই সমস্যার সমাধান মিটবে না, তা ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন মার্শা। তাই প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষদের জন্য নিজেই উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। এলজিবিটি সম্প্রদায়ের জন্য গড়ে তুলেছিলেন বিনামূল্যে থাকার আবাসন। 

১৯৯২ সালে হঠাৎই নিরুদ্দেশ হয়ে যান মার্শা। ৬ দিন পর তাঁর দেহ ভেসে ওঠে নদীর জলে। মার্কিন পুলিশ ‘আত্মহত্যা’ বলেই নিদান দিয়েছিল মার্শার এই রহস্যমৃত্যুকে। হয়নি কোনো তদন্তও। এর বহুবছর পর সমকামী পুলিশ অধিকর্তা মারিয়া লোপেজ নতুন করে তদন্ত শুরু করেন ২০১২ সালে। খুনের সম্ভাবনাকেই তুলে আনেন তিনি। তবে প্রমাণের অভাবে নিশ্চিত সমাধান দিতে ব্যর্থ হন মারিয়া। আর মার্শা? এলজিবিটি আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক হয়েও বিস্মৃতির আড়ালেই থেকে গেছেন তিনি। ২০১৯ সালে স্টোনওয়াল দাঙ্গার দায় স্বীকার করে ক্ষমাপ্রার্থনা করে মার্কিন পুলিশ। গ্রিনউইচ শহরে তৈরি করা হয় এলজিবিটি আন্দোলনের একটি স্মৃতিসৌধ। স্থাপিত হয় মার্শা এবং সিলভিয়ার পূর্ণ-অবয়ব মূর্তি। আসলে তাঁকে অস্বীকার করার জায়গা নেই কোনো। মার্শার দৃপ্ত কণ্ঠ সেই সত্তরের দশকে গর্জে না উঠলে হয়তো নায্য অধিকার থেকে আজও বঞ্চিত হতেন প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষেরা…

Powered by Froala Editor

More From Author See More