দাবা খেলার হাত ধরেই নেশার হাত থেকে মুক্তি পান এই গ্রামের মানুষ

কথায় বলে, ‘তাস, দাবা, পাশা। তিন সর্বনাশা।’ তাস আর পাশার কথা নাহয় তোলা থাক। কিন্তু বিশ্বনাথন আনন্দ, রমেশবাবু প্রজ্ঞানন্দ, দিব্যেন্দু বড়ুয়া, সূর্যশেখর গাঙ্গুলিদের মাটিতে দাঁড়িয়ে দাবা (Chess) খেলাকে অন্তত ‘সর্বনাশা’ বলা যায় না। যাঁদের সৌজন্যে ভারতের মুকুটে উঠেছে অসংখ্য শিরোপা। আর কলকাতার গড়িয়াহাটের মোড়ে গেলে আজও দেখা যায় চৌষট্টি খোপের খেলায় বুঁদ হয়ে আছে কত মানুষ। বুদ্ধির লড়াই চলছে সমানে সমানে। তবে ভারতে এমন স্থানও আছে, সেখানে শুধু একটি বিশেষ জায়গা নয়, গোটা গ্রামই মগ্ন হয়ে থাকে দাবা খেলায়। শখের জন্য নয়, এখানে দাবার সূত্রপাত হয়েছিল নেশার আসক্তি থেকে বাঁচার জন্য।

কেরালার ত্রিসুর জেলার এক শান্ত-সুন্দর গ্রাম মারোত্তিচাল (Marottichal)। পাহাড়ি রাস্তায় ট্রেকিংয়ের জন্য একসময় ভিড় লেগে থাকত পর্যটকদের। কিন্তু গত শতকের ছয়ের দশকের শেষ থেকে আচমকা বদলে যেতে থাকে গ্রামের পরিবেশ। না, প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগ নয়, মদ আর জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। যা ছিল এককালে প্রকৃতির স্বর্গরাজ্য, তার নতুন পরিচয় হতে থাকে নেশার গ্রাম হিসেবে। কমে আসতে থাকে পর্যটকের সংখ্যা। স্বাভাবিকভাবেই গ্রামের সামাজিক পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক পরিকাঠামো ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শুধু হাতে গোনা পরিবার ছিল এই বিপদ থেকে মুক্ত।

কোনোভাবেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না নেশামুক্তির সমাধান। স্থানীয় প্রশাসনের প্রচার কিংবা মাদক বন্ধে একাধিক অভিযান সত্ত্বেও মেলেনি সঠিক উত্তর। তবে উপায়? এগিয়ে এলেন সি উন্নিকৃষ্ণন (Unnikrishnan)। পেশায় চা বিক্রেতা। গ্রামেই একটি ছোটো দোকান ছিল সম্বল। গ্রামের আর পাঁচজনের থেকে পৃথক তাঁর জীবনযাত্রা। তিনি নিজে দাবার ভক্ত। কিংবদন্তি দাবাড়ু ববি ফিশারকে দেখেন অত্যন্ত সম্মানের চোখে। ফলে গ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি দেখে কিছুটা অসহায়বোধ করেছিলেন তিনি। এমনকি গ্রাম ছেড়ে চলেও যান কিছুদিনের জন্য। শেষ পর্যন্ত নিজের ভালোবাসাকেই ব্যবহার করলেন মাতৃভূমির হাল ফেরানোর জন্য।

অবশ্য একেবারেই সহজ ছিল না পথটা। প্রথমে তিনি দাবা শেখালেন গ্রামের বয়স্ক ও নেশামুক্ত লোকেদের। তাঁর চায়ের দোকানটিই হয়ে উঠল দাবা খেলার প্রধান স্থান। আলোচনাও হত শুধু খেলা নিয়েই। দুয়েক বছরের মধ্যে সাতশো জন মানুষ একেবারে পাকাপোক্ত হয়ে উঠল খেলাতে। তারপর বেছে নেওয়া হল নেশাগ্রস্ত লোকেদের। প্রাথমিকভাবে আগ্রহ না দেখালেও, সর্বত্র দাবা খেলা আর সেই নিয়ে আলোচনা প্রভাবিত করতে থাকে তাদেরও। এক পা, এক পা করে তারাও ঢুকে পড়ে দাবার আসরে। ক্রমে বদলাতে থাকে পরিস্থিতি। যেখানে একসময় বসত নেশার আড্ডা, সেখানে মানুষ ডুবে রইল দাবা নিয়ে। পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে, এটাই যেন নতুন ‘নেশা’ হয়ে উঠল মারোত্তিচালের আট থেকে আশি সকল মানুষের। 

আরও পড়ুন
দাবার 'সুলতান' হয়েও অধরা গ্র‍্যান্ডমাস্টার খেতাব, বিস্মৃতির অতলে এই ভারতীয়

বর্তমানে এই গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ৬০০০। যার ৮০ শতাংশ লোকের অবসর বিনোদনের উপায় একটিই। প্রতিটি পরিবারের অন্তত একজন সদস্য যুক্ত দাবা খেলার সঙ্গে। ছুটির দিনে রাস্তাঘাটে, বাড়ির উঠোনে, দোকানে দেখা যায় একটাই চিত্র। উন্নিকৃষ্ণনের চায়ের দোকানটি এখন পরিণত হয়েছে রেস্তোরাঁয়। দাবা খেলার জন্য সেখানে অবারিত দ্বার প্রত্যেকের। সব মিলিয়ে এখন মারোত্তিচালের নতুন নাম হয়েছে ‘দাবাগ্রাম’। এমনকি এশিয়ার মধ্যে একসঙ্গে হাজার জনের দাবা খেলার বিরল কৃতিত্ব তাদের মুকুটে। প্রশংসা জানিয়েছেন গ্র্যান্ডমাস্টার বিশ্বনাথন আনন্দও।

আরও পড়ুন
১৭০ বছর আগেই হারিয়েছিলেন সাহেবকে, ভুলে যাওয়া এক বাঙালি দাবাড়ুর গল্প

তবে তার থেকেও বড়ো এক সাফল্য পেয়েছেন এই গ্রামের বাসিন্দারা। তা হল সুস্থ জীবন। ঐতিহাসিক মতে ভারতেই সূত্রপাত হয় দাবা খেলার, আর সেই খেলার মাধ্যমেই একটা গোটা গ্রাম মুক্ত হয়েছে আধুনিক বিশ্বের অন্যতম জ্বলন্ত সমস্যা থেকে। দশকব্যাপী বিশৃঙ্খলা এখন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে সাদা-কালো খোপে। হট্টগোলও হয়, তবে তা জেতার আনন্দে। রাজা-মন্ত্রীর যুদ্ধে এক সামান্য বোড়ে হিসেবে যাত্রা শুরু হয়েছিল উন্নিকৃষ্ণনের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকেছিলেন তিনি। পৌঁছে গেছিলেন নেশা নামক বিপক্ষের খোপে। আর মগজাস্ত্রের এক চালে করেছিলেন কিস্তিমাত!

চিত্রঋণ : Indian Panorama

Powered by Froala Editor