পরনে সাদা অ্যাপ্রন। আর পাঁচটা রসায়নবিদ যেমন পরে থাকেন সাধারণত। সেই অ্যাপ্রন পরেই রাত-দিন গবেষণায় এক করেছেন ভদ্রমহিলা। ক্লান্ত লাগলে সেই অ্যাপ্রন পরেই খানিকটা জিরিয়ে নিচ্ছেন আরামকেদারায় বসে। আবার কখনও ক্লাস নিতে ছুটছেন প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর এসবের ফাঁকেই মাঝে মাঝে সেই জোব্বার পকেট থেকে বার করে দেখছেন ছোট্ট একটি কাচের শিশি। সেই শিশির ভেতরে ভরা তাঁর সদ্য আবিষ্কৃত এক অদ্ভুত পদার্থ। যা থেকে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে উজ্জ্বল সবুজাভ আলো। এই অদ্ভুত রশ্মি বিকিরণের কারণে তিনি তার নাম রেখেছেন রেডিয়াম।
আলাদা করে এই ভদ্রমহিলার পরিচয় না দিলেও চলে। মেরী কুরি। ‘আধুনিক পদার্থবিদ্যার জননী’ তিনি। সময়টা উনিশ শতকের শেষের দিক। পোল্যান্ডে তখন সোভিয়েত সৈন্যদের রাজত্ব। তাদের চোখে এড়িয়েই ভাসমান বিশ্ববিদ্যালয়ে লুকিয়ে ক্লাস করতে যেতেন তিনি। তার সঙ্গেই প্রতিকূলতার দোসর আর্থিক অনটন। পড়াশোনার খরচ টানতে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে গভর্নেসের কাজ করেছেন মেরী কুরি। কিন্তু রুশ-অধিকৃত পোল্যান্ডে ধীরে ধীরে কমে আসছিল পড়াশোনা, গবেষণার সুযোগ। অথচ তাঁর ইচ্ছে পদার্থবিদ্যার এক নতুন অধ্যায়কে তলিয়ে দেখার। যে অধ্যায়ের সূচনা করেছেন হেনরি বেকারেল। ততদিনে আসলে ‘ভুল’ করেই তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন ইউরেনিয়াম। অন্ধকারে এক অদ্ভুত রশ্মি বিকিরণ করে সে-পদার্থ।
গবেষণা আর অনুসন্ধানের নেশাতেই মাত্র বছর চব্বিশ বয়সে প্যারিসে চলে আসেন মেরী কুরি। তখনও অবশ্য তাঁর খাতায় কলমে নাম স্ক্লোডোওস্কা। প্যারিসে এসে বদলে গেল সেই নাম। ভর্তি হলেন বিশ্ববিখ্যাত সনবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিষয় গণিত বিজ্ঞান এবং পদার্থবিদ্যা। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান বিভাগে ১৮০০ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ছিলেন মাত্র ২৩ জন।
বছর খানেকের মধ্যেই ভালোবাসা, বিবাহ নতুন শহরে। জীবনসঙ্গী পিয়ের কুরিও একজন পদার্থবিদ। একইসঙ্গে শুরু হল গবেষণা। আর সেই গবেষণাই খুলে দিল পদার্থবিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্ত— তেজস্ক্রিয়তা এবং কণাতত্ত্ব। প্রথমে পোলোনিয়াম, তারপর রেডিয়াম— দু’-দুটি তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার করলেন কুরি দম্পতি। তবে সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে তা প্রমাণ করার জন্য ৪ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে তাঁদের। প্রায় ৭ টন পিচব্লেন্ড থেকে কুরি দম্পতি শেষ পর্যন্ত ১৯০২ সালে পৃথকীকরণ করেন তেজস্ক্রিয় মৌল দুটি। আসে যৌথ নোবেল পুরস্কার। বছর কয়েক পরে ১৯১১ সালে দ্বিতীয়বার রসায়নের জন্যও নোবেল পেয়েছিলেন মেরী কুরি।
সেইসময় তেজস্ক্রিয়তা সম্পর্কে বিজ্ঞানী-মহল ততটা ওয়াকিবহাল না থাকলেও, তার প্রভাব অজ্ঞাত ছিল না কালজয়ী বিজ্ঞানীর কাছে। তবুও মেরী কুরি সেই সম্ভাবনাকে দূরে ঠেলেই একাগ্রভাবে চালিয়ে গেছেন গবেষণা। জীবনযাপনের পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিল অসতর্কতা। বাড়ির ল্যাবরেটরিতে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকত পোলোনিয়াম, রেডিয়াম, প্লুটোনিয়াম, থোরিয়াম, ইউরেনিয়ামের মতো ভারী তেজস্ক্রিয় মৌল। অ্যাপ্রনের পকেটে তাদের যেমন বোতলবন্দি করে নিয়ে ঘুরতেন মেরী কুরি, তেমনই সংরক্ষণের জায়গা ছিল বেডরুমের ড্রয়ার। ঘুমানোর সময় বিছানাতেও তাঁর সঙ্গী হত এই তেজস্ক্রিয় মৌলগুলি।
নিশ্চুপেই যে ধীরে ধীরে ঘাতক হয়ে উঠছে তাঁর এই আবিষ্কার, তা নিজেও জানতেন কুরি। আক্রান্ত হলেন অ্যাপলাস্টিক অ্যানিমিয়াতে। তেজস্ক্রিয়তা শুষ্ক করে দিয়েছিল লোহিত রক্ত কণিকা উৎপাদনকারী অস্থিমজ্জাকে। অসুস্থতা বাড়তে বাড়তে পরিণত হয় মৃত্যুতে। ১৯৩৪ সালে মাত্র ৬৬ বছর বয়সেই মারা যান কুরি। তবে শেষ বয়সেও কন্যা ইরিনের সঙ্গে কাজ করে তৈরি করেছিলেন ১৮টি মোবাইল এক্স-রে যন্ত্র ‘পেটিটস কুরি’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আবহে চিকিৎসাবিজ্ঞানে যার প্রয়োগে প্রাণ বেঁচেছিল বহু মানুষের।
আরও পড়ুন
এখনও কতটা তেজস্ক্রিয় চের্নোবিল? সন্ধান দেবে রোবট-কুকুর
মৃত্যুর পর তাঁর বাড়িতেই চলত ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স অফ প্যারিস এবং কুরি ফাউন্ডেশনের গবেষণা এবং সভার বিভিন্ন কাজ। ১৯৭৮ সালে প্রথম কর্তৃপক্ষের নজরদারিতে ধরা পড়েছিল সেই বাড়ির ঘাতক-চরিত্র। শুধু গবেষকদের মধ্যেই নয় প্রতিবেশীদের মধ্যেই উচ্চ ক্যানসার-আক্রান্তের হার লক্ষ করেন তাঁরা। তারপর পরীক্ষা করেই চমকে ওঠেন বিজ্ঞানীরা। বাড়ির কোণায় কোণায় ছড়িয়ে রয়েছে তেজস্ক্রিয় মৌলের অণু! কুরির ব্যবহৃত প্রায় সমস্ত জিনিসেই।
এক বছরের মধ্যেই কুরির লেখা সমস্ত নোটবুক, ব্যবহারের সামগ্রী এবং গবেষণার নথিপত্র সরিয়ে নেওয়া হয় বাড়ি থেকে। নিষিদ্ধ করা হয় সে বাড়িতে সাধারণের প্রবেশ। প্যারিসে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে একটি বিশেষ মিউজিয়াম করে বর্তমানে সংরক্ষিত রয়েছে মেরী কুরির ব্যবহৃত সমস্ত সামগ্রী এবং গবেষণাপত্র। তবে লেডের বাক্সে বন্দি করে রাখা হয়েছে সেসব। কারণ? সেই ঘাতক তেজস্ক্রিয়তা। সাধারণ দর্শকের প্রবেশ তো নিষিদ্ধ বটেই, গবেষকদেরও তেজস্ক্রিয়তা প্রতিরক্ষামূলক বর্ম পরে লায়াবিলিটি ফর্মে স্বাক্ষর করে ঢুকতে হয় সেই মিউজিয়ামে। পাশাপাশি মেরী কুরির কফিনও পরবর্তীকালে ১ ইঞ্চি পুরু লেডের বাক্সে বন্দি করা হয়, তেজস্ক্রিয়তা রুখতে। রুশো, ভলতেয়ারের সঙ্গে তাঁর দেহ সমাধিস্থ রয়েছে ফ্রান্সের প্যান্থিয়ন সমাধিস্থলে।
কুরির বহুল-ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় মৌলগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল রেডিয়াম। যার ২২৬ আইসোটোপের অর্ধ-বয়স ১৬০১ বছর। কুরির ব্যবহারের পর পেরিয়েছে আনুমানিক এক শতক মাত্র। এখনও ১৫০০ বছরের অপেক্ষা তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা অর্ধেক হওয়ার। তারপর হয়তো সাধারণের জন্য অনুমতি মিলতে পারে পদার্থবিদ্যার ‘দি আল্ট্রা-মডার্ন লেডি’-র কর্মকাণ্ডকে চাক্ষুষ করার...
আরও পড়ুন
নিছক বিমান দুর্ঘটনা নয়; বিজ্ঞানী হোমি ভাবা-র ‘হত্যা’য় হাত ছিল আমেরিকার?
Powered by Froala Editor