শিকারীদের হাত থেকে বাঁচতে মৃত্যুর অভিনয় করে অনেক প্রাণীই। উপকথার গল্পেই তো সেই ছেলেটির কথা ছিল, মরার মতো শুয়ে থাকার কারণে যাকে ভালুক স্পর্শ করেনি। আসলে বনের প্রাণীদের থেকেই মানুষের এমন বুদ্ধি গজিয়েছে। শিকারী আসতে দেখলেই যেমন অনেক প্রাণী দ্রুত পালিয়ে যায়, অনেকে আত্মগোপন করে লতাপাতা বা ঘাসের মধ্যে, তেমনই অনেকে আবার দিব্যি মরার মতো শুয়ে থাকে। এও একরকমের অভিযোজন। তবে অবাক করার মতো বিষয় হল, শুধুই শিকারীর হাত থেকে বাঁচার জন্যই নয়। আরও নানা কারণে প্রণীরা মৃত্যুর অভিনয় করে।
ধরা যাক নার্সারি ওয়েব স্পাইডার নামের মাকড়সাটির কথাই। পৃথিবীর সব মহাদেশেই এদের দেখা মেলে। আর এই প্রাণীর মধ্যেও আছে থ্যানাটোসিস বা মৃত্যুর অভিনয় করার ক্ষমতা। এরা কিন্তু মোটেও শিকারীদের থেকে বাঁচার জন্য এই পদ্ধতি কাজে লাগায় না। বরং বোকা বানায় নিজের প্রজাতির মাকড়সাদেরই। পুরুষ মাকড়সারা স্ত্রী মাকড়সাদের আকৃষ্ট করতেই এমন কাজ করে। এর আগে পুরুষ মাকড়সাগুলি নিজেদের জালে যথেষ্ট পরিমাণ খাবার এনে রেখে দেয়। তারপর জালের মাঝে বসে মরার অভিনয় করে। স্ত্রী মাকড়সারা সেই খাবার খেতে এলেই হঠাৎ প্রাণ ফিরে পেয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুরুষরা। আর এভাবেই অনেক সময় জনন প্রক্রিয়া শুরু হয়।
তবে একইভাবে ‘দুশ্চরিত্র’ পুরুষদের হাত থেকে বাঁচতে নারীরাও ব্যবহার করে এই পদ্ধতি। যেমন স্ত্রী মুরল্যান্ড হকার ড্রাগনফ্লাইরা যদি দেখে কোনো পুরুষ জোর করে যৌন সম্পর্ক তৈরির জন্য এগিয়ে আসছে, ততক্ষণাৎ তারা মারা যাওয়ার অভিনয় করে। আকাশ থেকে টুপটাপ ঝরে পড়ে মাটিতে।
আবার শিকাররা প্রাণে বাঁচার জন্য যেমন মৃত্যুর অভিনয় করে, তেমনই শিকারীরাও মাঝে মাঝে একই পদ্ধতি বেছে নেয়। সাধারণত মাছেদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যায়। একই জলের মধ্যে বড়ো মাছেদের থেকে ছোটো মাছেরা সবসময় দূরত্ব বজায় রেখে চলে। আবার ছোটো মাছেদের গতিও বেশি। তাই বড়ো মাছরা সাময়িকভাবে শ্বাসযন্ত্র বন্ধ রাখে। তাদের মৃত মনে করে ছোটো মাছেরা এগিয়ে এলেই শুরু হয় শিকার।
তবে এতরকমের উদাহরণ সত্ত্বেও শিকারীদের হাত থেকে বাঁচাই এই থ্যানাটোসিস পদ্ধতির মূল কারণ, সেটা অস্বীকার করার জায়গা নেই।
বিবর্তন নিয়ে গবেষণার সময় চার্লস ডারউইন অবাক হয়েছিলেন একটি বিটল প্রজাতিকে দেখে। টানা ২৩ মিনিট প্রায় সমস্ত শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া বন্ধ রাখতে পারত এই পোকা। একইভাবে অবাক করে ইউরেলিওন নস্ট্রাস নামের অ্যান্টিলিয়নের অভিযোজনও। অন্তত ১ ঘণ্টা মৃতের অভিনয় করা তাদের পক্ষে কোনো ব্যাপারই না।
তবে এই প্রক্রিয়াকে সবচেয়ে শৈল্পিক স্তরে নিয়ে গিয়েছে নর্থ আমেরিকান ওপোসাম। এই স্তন্যপায়ী প্রাণীটি শিকারীর হদিশ পেলেই চোখ উলটে, জিভ বের করে একেবারে প্রস্তুত। এখানেই শেষ নয়। সেইসঙ্গে পেট থেকে নাড়িভুড়িও বের করে আনবে। আর শরীর থেকে তৈরি করবে এক অদ্ভুত পচা গন্ধ। এমন পচাগলা শিকারে কারোরই মন ভরবে না। অতএব নিরাপদ থাকার সম্ভাবনা প্রায় ১০০ শতাংশ।
তবে সমস্ত শিকারীদের চোখে কি এভাবে ধুলো দেওয়া সম্ভব? তাদের মধ্যেও দুএকজন শার্লক হোমস বা ফেলুদা থাকলে সত্যিটা জেনে ফেলতে খুব সময় লাগার কথা নয়। সেইসব গোয়েন্দাদের খবর অবশ্য বিজ্ঞানীরা রাখেন না। তবে কোনোদিন গবেষণার ফলে যে এমন তথ্য উঠে আসবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?
Powered by Froala Editor