এই গল্প একজন যুবরাজের গল্প। হতেই পারত কোনো রূপকথার মতো; যা আমরা পড়ি, যা আমরা ছবিতে দেখি। রাজপরিবার এবং তাঁদের যুবরাজ বলে কথা। ভবিষ্যতে তিনিই তো বসবেন সিংহাসনে! কত গল্প উঠে আসে আমাদের মনে। কিন্তু এই গল্প রূপকথার নয়। বরং প্রবলভাবে বাস্তব। আমাদের সমাজের কালো রূপের গল্প। যার ঘূর্ণাবর্তে পড়ে যে মানুষগুলি ছটফট করে, তাঁদেরই একজন প্রতিনিধি এই যুবরাজ। গুজরাটের রাজপিপলার ভবিষ্যতের মহারাজা হিসেবে মানা হচ্ছিল তাঁকে। কিন্তু যুবরাজ মানবেন্দ্র সিং গোহিল নিজের সত্তাকে চেপে রাখতে চাননি। বরং প্রকাশ্যে ওড়াতে চেয়েছিলেন রামধনু পতাকা, উড়তে চেয়েছিলেন নিজে। প্রবল ঝড়-ঝাপটার পর নিজের সমকামী সত্তাকে উদযাপন করেছেন তিনি। যুবরাজ মানবেন্দ্র সিং গোহিল বিশ্বের প্রথম যুবরাজ, যিনি সবার সামনে এসে নিজের সমকামী পরিচয়কে মেলে ধরেছিলেন।
বাবা হলেন মহারানা! উপাধিটা শুনলেই ইতিহাসের কত কথা মনে আসে আমাদের। সেই ইতিহাসেরই উত্তরাধিকার যুবরাজ মানবেন্দ্র সিং গোহিল। ছোটো থেকেই দেখেছেন তাঁদের পরিবারকে সবাই খুব মেনে চলে, শ্রদ্ধা করে। রাজবংশ হওয়ার জন্য কিছু প্রোটোকলও মেনে চলতে হয়। কিন্তু এসবের বাইরেও একটি সত্তা আছে। সেটা কী, ঠিক ধরতে পারতেন না মানবেন্দ্র। কিন্তু নিজের মধ্যে অনুভব করতেন। একটা সময় পর নিজেকে চিনলেন তিনি। বলা ভালো, আবিষ্কার করলেন। কিন্তু এই সমকামী সত্তার কথা বাইরের কাউকে জানাতে পারেননি তখন; এমনকি নিজের পরিবারের কাছেও নয়। সেই একই প্রশ্ন, যদি কেউ কিছু বলে? হ্যাঁ, রাজপরিবারের ক্ষমতাবান ব্যক্তি হয়েও এই চিন্তাই এসেছিল। ‘সবাই কী বলবে’…
একসময় প্রথা মেনে বিয়েও করলেন। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই সেটা গেল ভেঙে। মানবেন্দ্র খুশি ছিলেন না। বারবার মনে হচ্ছিল তিনি শুধু নিজেকেই নয়, ওই রাজপরিবারের মেয়েটিকেও ঠকাচ্ছিলেন। এরপর চলে এল মানসিক অবসাদ। আর তখনই পরিবারের সামনে এল মানবেন্দ্র’র সমকামী সত্তার কথা। যাতে এই ব্যাপারটা বাড়ির ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকে, তারই চেষ্টা করেছিলেন তাঁর পরিবার। কোথাও গিয়ে এই জায়গায় মিশে যাচ্ছে গোটা সমাজ। কিন্তু আটকে থাকেননি যুবরাজ মানবেন্দ্র। ২০০৬ সালে তাঁর জীবনের গল্প প্রথমবার সামনে আসে। বিশ্বের প্রথম সমকামী যুবরাজ হয়ে এলজিবিটি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন তিনি। শুধু ভারতেই নয়, বিদেশেও নানা জায়গায় অনুষ্ঠান করেছেন। আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে গিয়েছেন। ওপরা উইনফ্রের শো থেকে ইউরো প্রাইড রাইডের উদ্বোধন— মানবেন্দ্র সিং গোহিল স্রেফ রাজপিপলার ভবিষ্যতের মহারানা নন, বিশ্বের সমকামীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম আওয়াজও।
২০০০ সাল থেকে তিনি শুরু করেন নিজের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘লক্ষ্য ট্রাস্ট’। শুধু এলজিবিটি মানুষের পাশেই দাঁড়ায় না এই সংস্থা; এইডস আক্রান্তদের পাশেও এগিয়ে আসে তারা। সেক্স এডুকেশন নিয়েও নানা কর্মসূচি আয়োজন করে এই সংস্থা। সমকামী মানুষ, এইডস আক্রান্তরা যাতে সমাজে সুস্থভাবে বাঁচতে পারে। এখনকার করোনার পরিস্থিতিতেও ঝাঁপিয়ে পড়েছে ‘লক্ষ্য ট্রাস্ট’। ভাদোদরা, সুরাট, রাজকোটের বস্তি এলাকার মানুষ ও দিনমজুরদের দায়িত্বও নিয়েছে হাসিমুখেই।
মানবেন্দ্র বারবার বলেছেন সমাজের এই অদ্ভুত মানসিকতার কথা। যেখানে সমকামী মানুষকে ‘মানুষ’ হিসেবেই দেখা হয় না। যেন কোনো একটা রোগ, বা ভিনগ্রহের জীব। রাজপরিবার হোক বা সাধারণ ঘর— সব জায়গার সামগ্রিক চিত্রটা একই। এসবের বিরুদ্ধেই বারবার প্রতিবাদ জানিয়েছেন তিনি। ২০০৮ সালে ভারতের প্রথম সমকামী পুরুষ হিসেবে একটি বাচ্চাকে দত্তক নেন তিনি। এইভাবেই গণ্ডিগুলো পেরিয়ে চলেছেন তিনি। আরও হাজার হাজার মানুষকে সাহসও দিচ্ছেন।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মধ্য আমেরিকার প্রথম সমলিঙ্গ বিবাহ কোস্টারিকায়, সাক্ষী রইল গোটা দেশ