চল্লিশের দশকের মুম্বইয়ের ফিল্ম দুনিয়া। কত লোকে আসছে, টিকে থকার লড়াই লড়ছে। কেউ সিংহাসনে বসছে, কেউ আবার হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধ গলির ভেতর। দেশও স্বাধীন হয়নি; চারিদিকে আগুন জ্বলছে। এরই মাঝে দুটি চরিত্রকে বেছে নেব আমরা। দুজনেই মুম্বইয়ের সিনেমা জগতে খুঁজে নিচ্ছেন নিজের নিজের জায়গা। একজন লেখক, চিত্রনাট্য লিখে এসেছেন এতদিন। আরেকজন কলকাতা থেকে এসেছেন, বাঙালি। পরবর্তীতে দুজনকেই আপন করে নিয়েছে ফিল্ম জগত। অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধুত্বও তৈরি হয়ে যায়। বাঙালি অভিনেতাটির খ্যাতি ছাড়িয়ে যায় দিগন্ত। আর চিত্রনাট্যকার? তাঁর নামটিই যথেষ্ট, নামেই তাঁর সার্বিক পরিচয়— সাদাত হাসান মান্টো। আর অভিনেতাটি হলেন অশোককুমার গাঙ্গুলি, এক কথায় অশোক কুমার।
মান্টোর জীবনের নানা কাহিনিতে, ছবিতে এই বন্ধুত্ব ধরা পড়েছে। অনেক মুহূর্ত একসঙ্গে তৈরি করেছেন দুজনে মিলে; কি পর্দায়, কি পর্দার বাইরে। মজার মজার গল্পও জুড়ে আছে সেখানে। আর এই সবের শুরু ফিল্মিস্তান স্টুডিওতে। বিখ্যাত ‘বম্বে টকিজ’ যখন ভেঙে গেল, তখন ১৯৪৩ সালে সেখান থেকেই একটা দল বেরিয়ে এসে তৈরি করেছিল এই সংস্থা। এই দলে যেমন ছিলেন অশোক কুমার, তেমনই ছিলেন শশধর মুখোপাধ্যায়, রায়বাহাদুর চুনিলাল, জ্ঞান মুখোপাধ্যায়। ইতিমধ্যে ফিল্মিস্তানেই চাকরি করতে এসেছেন মান্টো। সেখানেই মুখোমুখি আলাপ দুজনের। প্রথম আলাপ মধুর না হলেও, তাঁদের বাকি বন্ধুত্বের গল্প সেই আক্ষেপ মিটিয়ে দেয়।
বাংলা তো বটেই, গোটা ভারত অশোক কুমারকে আরও একটি নামে চিনত— ‘দাদামণি’। প্রথম প্রথম ‘অশোক’ বলেই ডাকতেন মান্টো। হঠাৎ একদিন অশোক কুমার ডাকলেন বন্ধুকে, বললেন দাদামণি বলে ডাকতে। এদিকে মান্টোও নাছোড়বান্দা, কেন ডাকতে যাবেন তিনি? সটান বলেই বসলেন, ‘দাদামণি ডাকতে যাব কেন? তুমি কি আমার থেকে বড়ো?’ অকাট্য যুক্তি! তবে প্রমাণ করা হবে। হিসেব করে দেখা গেল, সত্যি সত্যিই অশোক কুমার মান্টোর থেকে মাত্র কয়েক দিনের বড়ো। ব্যস, সমস্ত বিতর্কের অবসান। কয়েকদিনের হলেও, বড়ো তো! সেই থেকে মান্টোর মুখের ‘অশোক’ বদলে গেল ‘দাদামণি’-তে। পরে তিনি স্বীকারও করেছেন, এই বাঙালিদের এই ডাকটা তাঁর একান্ত পছন্দের। বড়ো মিষ্টি…
সাদাত হাসান মান্টোকে গোটা পৃথিবী চেনে একজন কিংবদন্তি ছোটোগল্পকার হিসেবে। যার কলম ঝলসে উঠত সবসময়। সমাজের সমস্ত কালো দিক, যাকে খুব পরিপাটি করে আমরা এড়িয়ে যাই, সেই সত্যিটাকেই আয়না করে তুলে ধরতেন তিনি। কিন্তু এই মান্টোই একদিন সিনেমায় নেমেছিলেন। শুধু চিত্রনাট্যকার হিসেবে নয়, অভিনেতা হিসেবেও! আর তার পেছনেও রয়েছে তাঁর ‘দাদামণি’ অশোক কুমারের হাত।
আরও পড়ুন
উদ্বোধন করেছিলেন খোদ সুভাষচন্দ্র, ধ্বংসের পথে বাঙালির প্রথম সিনেমা হল ‘মিত্রা’
১৯৪৬ সাল, স্বাধীনতার মাত্র এক বছর আগের ঘটনা। ফিল্মিস্তান স্টুডিও একটি নতুন সিনেমা নিয়ে কাজ শুরু করে। নাম ‘আট দিন’। চিত্রনাট্য সাদাত হাসান মান্টোরই। ছবিতে অশোক কুমার একটি নতুন ভূমিকায় নামেন। এই ছবির পরিচালনার পুরো দায়িত্বটা সামলান তিনি; সেইসঙ্গে শামসের সিংয়ের চরিত্রে অভিনয়। বিপরীতে রয়েছেন ভিরা নামের এক নবাগতা। মান্টো দেখছেন তাঁর বন্ধুকে, যেন নতুন করে ডানা মিলছেন। বাথরুমে পড়ে আছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, ওটাই অশোক কুমারের চিন্তার জায়গা ছিল কিনা! অত্যন্ত যত্ন নিয়ে তৈরি করেছিলেন সিনেমাটি।
আরও পড়ুন
জাতীয় পুরস্কার পেয়েও অনালোচিত সুদীপ্ত-ফারহা; মান কমছে সিনেমাপ্রেমী বাঙালির?
কিন্তু হঠাৎই তৈরি হল সমস্যা। ওই সিনেমাতেই কৃপারাম বলে একটি চরিত্র ছিল; একজন ফ্লাইট অফিসার, একটু পাগলাটে ধরনের। তাতে প্রাথমিকভাবে ঠিক করা হয়েছিল শশধর মুখোপাধ্যায়কে। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল, ক্যামেরা রেডি, আলোও রেডি। কিন্তু এসবের সামনে দাঁড়াতেই ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে গেলেন শশধরবাবু। না, এই অভিনয় কিছুতেই তিনি করতে পারবেন না! বসলেন বেঁকে…
আরও পড়ুন
হারিয়ে যাওয়া সিনেমা হলগুলির ইতিহাস ধরে রাখছেন হেমন্ত
এদিকে অশোক কুমার পড়লেন মহা ঝামেলায়। তাহলে কী করে হবে সিনেমাটি? মান্টো’র বাড়িতে বসে এইসবই ভাবছিলেন তিনি। হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন দাদামণি। মান্টোকে চেয়ার থেকে তুলে স্টুডিওয় নিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘তুমিই এই চরিত্রটি করবে!’ মান্টো রীতিমতো আকাশ থেকে পড়লেন। এ কী বলছেন! মান্টো করবে অভিনয়! অবশ্য দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সরিয়ে ‘কৃপারাম’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন সাদাত হসন মান্টো। তাঁর জীবনের এক ও একমাত্র অভিনয়।
১৯৪৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আট দিন’ সিনেমায় জ্বলজ্বল করছে মান্টো’র নাম। কিন্তু আরও একটি ব্যাপার দেখলে খটকা জাগে। পরিচালকের জায়গায় নাম ‘ডি.এন.পাই’। অশোক কুমারের নাম কেবল অভিনেতা হিসেবে! অথচ তিনিই তো পরিচালকের ভূমিকাটি সামলেছিলেন। তাহলে? এখানেই শুনে নেওয়া যাক মান্টো’র কথা। ‘ডি.এন.পাই পরিচালনার এক ফোঁটাও দায়িত্ব সামলাননি। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ এডিটর। এই সিনেমাতেও তিনিই ছিলেন এডিটর। এখন বম্বে টকিজ বা ফিল্মিস্তানের একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল। এরা সবাই একটা গ্রুপ হয়ে সিনেমা শুরু করতেন। কোনো নির্দিষ্ট দায়িত্ব থাকত না। পরিচালনার ব্যাপারটিও ছিল সেরকম। সিনেমা শেষ হওয়ার পর সবাই একসঙ্গে বসে একজনকে বেছে নিত। তাঁর নামই পরিচালকের জায়গায় থাকত।’ এক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই হয়েছে।
আস্তে আস্তে সময়ের চাকা গড়িয়ে চলে। দেশে শুরু হয় দাঙ্গা; ভাগ-বাঁটোয়ারার খেলা চলে সর্বত্র। মানুষ আর মানুষ থাকে না, পিশাচে পরিণত হয়। ধর্মের নামে ভাগাভাগি অসহ্য লাগল মান্টোর। একের পর এক লিখে চললেন তিনি। তাঁর লেখা ছিটকে দিতে লাগল সবাইকে। সত্যি কথা তকমা পেল ‘অশ্লীল’-এর। তখন মান্টো তাঁর প্রাণের বন্ধু দাদামণির থেকে অনেক দূরে। নেশায় পাগল, সমাজের নিষ্ঠুরতায় আহত এক শিল্পী। মান্টো ছিলেন সত্যদ্রষ্টা। শুধু নিজের সাধের মুম্বাই, প্রিয় মানুষদের ছেড়ে আসার দুঃখ তাঁর কখনই যায়নি। দাদামণি অশোক কুমার গাঙ্গুলিও কি ভুলতে পেরেছিলেন তাঁর প্রিয় ‘মান্টো’কে!
ঋণ— গাঞ্জে ফেরেশতে, সাদাত হাসান মান্টো
Powered by Froala Editor