১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট। তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় কি সত্যিই প্রাণ হারিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু? দেশের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করেননি সেই মৃত্যুসংবাদ। আজও অনেকেই মনে করেন, নেতাজি তার পরেও বেঁচে ছিলেন। কিন্তু দেশের সরকারি নথিতে এখনও নেতাজির মৃত্যুদিন হিসাবে ১৮ আগস্ট দিনটিকেই উল্লেখ করা হয়। সমস্ত সরকারি নথি মনে করে বিমান দুর্ঘটনায় সত্যি মৃত্যু হয়েছিল নেতাজির।
না, একটু ভুল হল। সমস্ত সরকারি নথি বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর কথা স্বীকার করে না। নেতাজির মৃত্যুরহস্য মীমাংসার জন্য তৈরি হওয়া তিনটি তদন্ত কমিশনের একটির রিপোর্টে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, তাইহোকু বিমান বন্দরে মৃত্যু হয়নি নেতাজির। তিনি তার পরেও বেঁচে ছিলেন। হ্যাঁ, মাত্র ১৫ বছর আগে আলোরন তোলা মুখার্জি কমিশনের কথাই এসে পড়ে। দীর্ঘ ৬ বছর ধরে তদন্তের শেষে তিন খণ্ডের রিপোর্ট জমা দেয় মুখার্জি কমিশন। ২০০৫ সালে বিদেশ মন্ত্রালয়ের হাতে এসে পৌঁছয় সেই রিপোর্ট। ৬০ বছর আগে জন্ম নেওয়া প্রশ্ন ঘিরে আবারও শুরু হল আলোচনা।
নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি। হাজার হাজার মানুষের এই বিশ্বাস বাস্তব ভিত্তি খুঁজে পেল একটি রিপোর্টে। তবে এই বিরাট তদন্ত প্রক্রিয়া এবং অসংখ্য বিতর্কের মাঝে নিজেকে যতটা সম্ভব আড়ালেই রাখার চেষ্টা করেছিলেন বিচারপতি মনোজ কুমার মুখার্জি। হ্যাঁ, তার নামেই মুখার্জি কমিশন। কোন কোন প্রক্রিয়ায় তদন্ত এগোবে, কোন কোন দিক থেকে প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা হবে, নিরলস পরিশ্রমে সমস্ত পরিকল্পনার ছক তৈরি করেছিলেন একজন বাঙালি।
তখন ১৯৯৯ সাল। কেন্দ্রে প্রথম এনডিএ সরকার তৈরি হয়েছে সদ্য। কংগ্রেসের বিপরীতে দাঁড়িয়ে একটি স্থায়ী সরকারের পাশাপাশি উঠে এল বেশ কিছু পুরনো বিতর্কও। এর মধ্যে নেতাজি অন্তর্ধান রহস্য অবশ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা বিশ্বাস করতেন নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি, তাঁদের অনেকের মতেই জওহরলাল নেহেরু এবং তৎকালীন কংগ্রেস নেতাদের অনেকেই প্রকৃত সত্য চাপা দিয়েছিলেন। অ-কংগ্রেসি সরকারের হাত ধরেই প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন হবে বলে আশা করেছিলেন অনেকে। কেন্দ্র থেকে তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশ আসতে বেশি দেরি হল না। আর কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে পুরো তদন্ত প্রক্রিয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন সদ্য অবসর নেওয়া বিচারপতি মনোজ কুমার মুখার্জি।
আরও পড়ুন
তাঁর সঙ্গে খাবার ভাগ করে নিতেন নেতাজি; কৈশোরের স্মৃতিতে ডুবে ৯৩ বছরের নাগা বৃদ্ধ
শনিবার কলকাতায় নিজস্ব বাসভবনে মৃত্যু হল বিচারপতি মুখার্জির। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। বার্ধক্যজনিত কারণেই বিচারপতি মুখার্জির মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। মনোজ কুমার মুখার্জির মৃত্যু সংবাদের সঙ্গে সঙ্গেই আবারও উঠে আসছে একটি বিতর্কের প্রসঙ্গ। ৭৫ বছর ধরেও যে রহস্যের মীমাংসা হয়নি। সত্যিই কি তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন নেতাজি?
আরও পড়ুন
নেতাজির দুটি আগ্নেয়াস্ত্রকে নতুন করে লাইসেন্স দিতে চলেছে কলকাতা পৌরসভা
১৯৩৩ সালে পরাধীন ভারতে জন্ম মনোজ কুমার মুখার্জির। ১৯৫৬ সালে আইনশিক্ষা শেষ করে আসানসোল আদালতে শুরু হল কর্মজীবন। এরপর ১৯৬২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবি ছিলেন তিনি। প্রথম বিচারপতির ভূমিকায় কাজ শুরু করেন ১৯৭৭ সালে কলকাতা হাইকোর্টে। এরপর লক্ষ্ণৌ এবং মুম্বাই হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির দায়িত্বও সামলেছেন তিনি। ১৯৯৩ সালে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি হলেন মনোজ কুমার মুখার্জি। ১৯৯৯ সালে সেখান থেকেই অবসর নিলেন। কিন্তু তখনই এসে পড়ল জীবনের সবচেয়ে বড়ো কাজের দায়িত্বও।
আরও পড়ুন
গুমনামী বাবা নেতাজি নন, বরং তাঁর অনুগামী – চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট কমিশনের
মুখার্জি কমিশনের রিপোর্ট সাক্ষীদের জবানবন্দি নেওয়ার পাশাপাশি কিছু প্রত্যক্ষ প্রমাণের বিশ্লেষণে হাত লাগায়। রিপোর্টের প্রথম খণ্ডে অবশ্য স্পষ্ট বলা হয়, সাক্ষীদের জবানি অনুযায়ী বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু সম্পর্কে কোনো সন্দেহই থাকে না। তবে এরপরেই হাজির করা হয় এক বিরোধী প্রমাণ। জাপানের রেনকোজি মন্দিরে নেতাজির যে চিতাভস্ম রাখা আছে, তার ডিএনএ পরীক্ষা করে মুখার্জি কমিশন। আর এই রিপোর্টে স্পষ্ট হয়ে যায়, নেতাজির চিতাভস্ম বলে যা সংরক্ষণ করা হয়েছে তা আর যারই হোক, নেতাজির নয়। অবশ্য সেই ছাই একজন জাপানি সেনার বলেও চিহ্নিত করা হয়। আর সেই সেনার মৃত্যু হয়েছিল ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসেই, তবে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে।
মুখার্জি কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী নেতাজি জাপান থেকে গোপনে রাশিয়ায় চলে গিয়েছিলেন। তবে তারপরের গতিবিধি সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেনি কমিশন। গুমনামী বাবার তত্ত্বও শেষ পর্যন্ত খারিজ করেছিলেন বিচারপতি মুখার্জি। রিপোর্টে তিনি উল্লেখ করেছেন, গুমনামি বাবার সঙ্গে নেতাজির ডিএনএ নমুনা মেলে না। রিপোর্টের এই সীমাবদ্ধতাটুকু ধরেই বিরোধিতায় সরব হয়েছিলেন অনেকে। এমনকি তার মধ্যে নেতাজির পরিবারও সামিল হয়েছিল। একবাক্যে তাঁরা বলেন, এইসবই জাস্টিস মুখার্জির মনগড়া গল্প। তিনি নিজেই জানেন না বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু না হলে তাঁর কী হল।
হ্যাঁ, সব প্রশ্নের জবাব হয়তো দিতে পারেনি মুখার্জি কমিশন। তবে যদি বিমান দুর্ঘটনায় সত্যিই প্রাণ হারিয়ে থাকেন নেতাজি, তাহলে কেন তাঁর চিতাভস্মের জায়গায় অন্য কারোর ছাই থাকবে? এই প্রশ্নের উত্তর আজও পাননি কেউ। মুখার্জি কমিশনের রিপোর্ট শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করেনি বিদেশ মন্ত্রক। ভারত সরকারের মত ছিল, শাহানওয়াজ কমিশন এবং খোসলা কমিশনের রিপোর্টেই নেতাজির বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু প্রসঙ্গে যথেষ্ট তথ্য রয়েছে। এই নিয়ে আর তদন্তের প্রয়োজন নেই। তাছাড়া ততদিনে পার্লামেন্টের সমীকরণ বদলে গিয়েছে। মুখার্জি কমিশন যেন রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে জন্ম নেওয়া একটা রাজনৈতিক বলিতে পরিণত হল। তবে এখনও সরকারিভাবে রিপোর্ট স্বীকৃত না হলেও বিতর্কের অবসান হয়নি। সন্দেহের পক্ষে যে প্রশ্নগুলি তুলেছিলেন জাস্টিস মুখার্জি, সেসবের উত্তর না নিয়েই বিদায় নিলেন তিনি।
Powered by Froala Editor