১৯৫০ সাল। স্বাধীনতা এসেছে সদ্য। সে-সময়ে কলকাতার অলিতে গলিতে ফুটবল। ‘চাইনিজ ওয়াল’ গোষ্ঠ পাল জমানার পর মহামেডানের ঐতিহাসিক তিরিশের দশক, ময়দানে কিছুটা ঝড়ের মত এসে পড়া শৈলেন মান্না এবং ইস্টবেঙ্গলের পঞ্চপাণ্ডব - সব মিলিয়ে সদ্যস্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশে ফুটবল একটা সংক্রমণের মতো ছড়িয়ে পড়ছিল। সেই প্রবল স্রোত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেননি এক তরুণ। কলকাতার ফুটবল ময়দানের দ্বিতীয় ডিভিশনের ক্লাব ইয়ং বেঙ্গলের হয়ে তিনি ফুটবল খেলতেন। পরে তিনি আইএফএ লিগের প্রথম ডিভিশনের ক্লাব এরিয়ান ও ভবানীপুরের হয়েও ফুটবল খেলেন। ১৯৪৬ সালে ক্যালকাটা রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের রেফারি পরীক্ষাতেও পাস করেছিলেন। কিন্তু কে ভেবেছিল ভারতের ব্যাডমিন্টন খেলার ইতিহাসে এই মানুষটিই মোড় ঘুরিয়ে দেবেন?
তিনি মনোজ গুহ। ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের একেবারে গোড়ার দিকের আন্তর্জাতিক তারকা।
বিখ্যাত কুস্তিগির গোবর গুহ-র জামাই শরৎচন্দ্র মিত্র কলকাতা শহরে ব্যাডমিন্টন খেলা চালু করেন। মনোজ গুহ এই খেলায় খাস কলকাতা থেকেই হয়ে ওঠেন এক কিংবদন্তি। ১৯৫০ সালে ভারতবর্ষের ব্যাডমিন্টনের সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম ছিলেন নান্দু নাটেকার। নান্দুর পাশে একই সময়ে নিজেকে একটু একটু করে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন মনোজ গুহ। ১৯৫১ সালে দেশের প্রথম তিনজন শ্রেষ্ঠ শাটলারের একজন হিসেবে নিজের নাম প্রথম তুলে ধরেন তিনি। সিঙ্গেলস এবং ডাবলস - দুই ক্ষেত্রেই মনোজের ক্ষিপ্রতা সাড়া ফেলে ক্রীড়া মহলে। ১৯৪৭ সালে শ্রীলঙ্কা সফরকারী ভারতীয় ব্যাডমিন্টন দলের অন্যতম সম্পদ ছিলেন মনোজ। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ১৩ বছরে সিঙ্গলসে আটবার চ্যাম্পিয়ন রাজ্য ব্যাডমিন্টনে৷ ডাবলসে ৬ বার, ৫ বার মিক্সড ডাবলসে৷
তবে মনোজ গুহ নিজেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে চলে যান, যখন তিনি সঙ্গী হিসেবে পান আরেক দুরন্ত শাটলার গজানন হেমাডিকে। ১৯৫১-৫২ সালে এবং ১৯৫৪-৫৫ সালে গজানন হেমাডিকে সঙ্গী করে বিশ্ব ব্যাডমিন্টনে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন মনোজ৷ কোর্টে তীব্র গতি, নেটের সামনে ভয়ঙ্কর ক্ষীপ্র মনোজ কেড়েছিলেন নজর৷ টমাস কাপে কখনও হারিয়েছেন ডেনমার্ক, আমেরিকাকে৷ এই সময়ে বিশ্ব ক্রমতালিকায় চার নম্বরে উঠে আসেন মনোজ গুহ। আজ আমরা পিভি সিন্ধু, সাইনা নেহওয়ালদের কথা গর্বের সঙ্গে বলি। অথচ প্রায় ৭০ বছর আগে ভারতকে আন্তর্জাতিক ব্যাডমিন্টনে এক অন্যমাত্রায় নিয়ে চলে গিয়েছিলেন এক বাঙালি। অনেকাংশেই যে ইতিহাস বিস্মৃত।
সে সময়ের বিখ্যাত আমেরিকান ব্যাডমিন্টন জুটি ওয়াইন্ড রজার্স-বব উইলিমাসকে হারিয়ে দেন মনোজ-হেমাডি। এই সময় বিশ্ব ব্যাডমিন্টনের ইতিহাসে ভারত যে এক তৃতীয় শক্তি হিসেবে উঠে এসেছিল, তার কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার মনোজ গুহ।
ক্রীড়াবিদ হিসাবে মনোজ গুহর সবচেয়ে বড়ো কীর্তি ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে নয়া প্রজান্মকে প্রতিষ্ঠা করা। আশির দশকে ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে এক নবীন প্রজন্মের জোয়ার দেখা গিয়েছিল। তার জনক ছিলেন মনোজ গুহ।
সে-সময়ে তিনি চাকরি করেন অমৃতবাজার পত্রিকায়। মনোজ গুহর সঙ্গে অমৃত বাজার পত্রিকাতেই ক্রীড়া সাংবাদিক হিসাবে কাজ করতেন অজয় বসু, কমল ভট্টাচার্যরাও। বলতে গেলে কর্মক্ষেত্রে বরাবর একদল ক্রীড়াব্যক্তি ও ক্রীড়া সাংবাদিকদের সাহচর্যও পেয়ে এসেছিলেন তিনি। নিজের খেলা শেষ করার পর কোচিং-এর দিকে নজর দেন মনোজ। জীবনের শেষ অবধি তিনি কোচিং-কে ভালোবেসে গেছেন। তাঁর হাত ধরেই কলকাতার বুক থেকে উঠে এসেছিলেন একাধিক শাটলার। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম অমৃতা মুখোপাধ্যায়, সৌমেন ভট্টাচার্য। এই মনোজ গুহ-র হাতেই ব্যাডমিন্টনের হাতেখড়ি হয় ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শাটলার প্রকাশ পাডুকনের। ব্যাঙ্গালোরে কোচিং করানোর সময় প্রকাশ পাডুকোনের বাবা রমেশ পাডুকোন প্রকাশকে নিয়ে আসেন মনোজবাবুর কাছে। কিন্তু ১২ বছরেরও কম বয়স হওয়ায় প্রকাশকে ক্যাম্পে নিতে পারেননি তিনি। কিন্তু রমেশ নাছোড়বান্দা। তাই বাধ্য হয়েই প্রকাশের ব্যডমিন্টনে হাতেখড়ি হয় মনোজ গুহর হাতে।
মনোজ গুহ-ই সম্ভবত প্রথম, যিনি ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের অপেশাদারিত্ব নিয়ে সরব হন। আন্তর্জাতিক স্তরে খেলার ফলে তিনি বুঝেছিলেন, ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে কমবয়সি খেলোয়াড়ের ফিটনেসকে গুরুত্ব দেওয়া সবচেয়ে জরুরি। আশির দশকে কলকাতার উপকণ্ঠে বাঘাযতীনের কাছে কুসুম কাননের অরুণোদয় সংঘের মাঠে তৈরি করেছিলেন ব্যাডমিন্টন অ্যাকাডেমি। যেখান থেকে একের পর এক জাতীয় সেরা প্লেয়ার তুলে এনেছিলেন।
ভারতের আন্তর্জাতিক মানের ব্যাডমিন্টন তারকার নাম খুঁজলে আজ গুগল যে কয়েকটি নাম তুলে আনছে, তাঁদের কোত্থাও তিনি নেই। একই সময়ের নান্দু নাটেকার আছেন, আশির দশকের প্রকাশ পাডুকোন, পরবর্তী সময়ে পুল্লেলা গোপীচাঁদ থেকে হালফিলের সাইনা থেকে সিন্ধু সব্বাই আছেন। বাঙালি মনোজ গুহ অনেকাংশেই হারিয়ে গেছেন। ২০১৮ সালে প্রয়াত হয়েছেন তিনি। জীবনের শেষ দিন অবধি সাইনা-সিন্ধুদের খেলা মন দিয়ে দেখতেন এই কিংবদন্তি। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের ঐ সাফল্য কিংবা ভারতীয় ব্যাডমিন্টনকে আন্তর্জাতিক স্তরে উন্নীত করা এই মনোজ গুহ সারাজীবন ফুটবল থেকে রেফারিং, সাংবাদিকতা - সব ক্ষেত্রেই নিজের প্রতিভার ডানা মেলেছিলেন। ভারতীয় ক্রীড়াকে তিনি দিয়েছেন দু-হাত ভরে, বিনিময়ে তাঁকে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে ফেলেছি আমরা। এ-ব্যর্থতার দায় বর্তাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে...
Powered by Froala Editor