ছোট্ট একটা ক্লাসরুম। পর পর বেঞ্চিতে বসে রয়েছে জনা পঁচিশ বাধ্য শিক্ষার্থী। হোমওয়ার্ক জমা দিয়েছে শিক্ষকের কাছে। এবার পড়া ধরার পালা। সামনের সারির এক ছাত্রীকে নাম জিজ্ঞেস করলেন শিক্ষক। ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে উত্তর এল, ‘মাই নেম ইজ শোকনাওলা। আই অ্যাম ফাইন। আই আম সেভেনটি নাইন ইয়ারস ওল্ড। থ্যাঙ্ক ইউ।’ শিক্ষক বাহবা দিতেই চওড়া হাসি খেলে গেল ঠোঁটে। কিন্তু ৭৯ বছর! স্যরের সঙ্গে কি তবে মজা করেই এমন উত্তর শিক্ষার্থীর?
না, অবাস্তব কোনো গল্প নয়। মণিপুরের কামজং জেলার প্রান্তিক চাট্রিক খুলেন গ্রামের ছবি এমনটাই। স্কুল ইউনিফর্ম পরা শিশুরা নয়, বরং জীবনসায়হ্নে এসে দাঁড়ানো প্রবীণরাই এখন মণিপুরের এই গ্রামীণ স্কুলের শিক্ষার্থী। তাঁরা সকলেই পেরিয়েছেন ৬৬-র গণ্ডি। এ-স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেবলমাত্র একজনই ক্লাস ফোর পাশ। বাকিরা কোনোদিন পা দেননি স্কুলের চত্বরে। তাঁদের শৈশবে প্রান্তিক ভারতে শিক্ষার পরিকাঠামো ছিলই বা কোথায়? বা থাকলেও সংসার সামলানো আর উপার্জনের তাগিদে আর হাঁটা হয়নি সে-পথে। তবে মহামারী আর লকডাউনই সেই সুযোগটা করে দিল তাঁদের।
ভারতে দ্বিতীয় তরঙ্গের প্রকোপের পর শুরু হয়েছিল এই স্কুল। মণিপুরেরই এক অলাভজনক সংস্থা ‘জেমসন হাওরি’-র উদ্যোগে চালু হয় এই অভূতপূর্ব শিক্ষাব্যবস্থা। মূলত গ্রামীণ অঞ্চলে শিক্ষাব্যবস্থার প্রসার নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা আসছে এই সংস্থাটি। কিন্তু প্রবীণদের জন্য এমন উদ্যোগ এই প্রথম। তবে হঠাৎ কেন এমন এক ব্যতিক্রমী পথে হাঁটলেন তাঁরা?
সংস্থার কর্ণধার ও সমাজকর্মী সরিন্থান হাওরি জানাচ্ছেন, মণিপুরের এই গ্রামে বেশিরভাগ প্রবীণ নাগরিকই বসবাস করেন একা। তাঁদের সন্তান, এমনকি নাতি-নাতনিরাও চাকরি কিংবা পড়াশোনার সূত্রে থাকেন দূরের শহরে। সেই কারণেই প্রবীণদের একাকিত্ব কাটাতে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ শুরু করেছিল সংস্থাটি। পরে দ্বিতীয় পর্যায়ের লকডাউনের সময় ১ মার্চ থেকে শুরু হয় স্কুল।
আরও পড়ুন
করোনাকালে অতিরিক্ত পারিবারিক নির্যাতনের শিকার প্রবীণরা, জানাচ্ছে রিপোর্ট
গ্রামের অধিকাংশ মানুষই কৃষি নির্ভর হওয়ার কারণে, রোজই সকলে হাজির হতে পারেন না এই স্কুলে। তবে ২০ জন শিক্ষার্থী নিয়ম মেনেই পাঠ নেন প্রতিদিন। আর এই পাঠ যে তাঁদের মানসিকভাবেও চাঙ্গা রাখছে তাঁদের— স্পষ্ট সেটাও। এখনও পর্যন্ত ইংরাজি হরফ, শব্দ, বাক্য গঠন, ১ থেকে ১০০০ অবধি সংখ্যা, প্রাথমিক স্তরের অঙ্ক শিখে উঠতে পেরেছেন তাঁরা। গল্পের মধ্যে নিচ্ছেন আঞ্চলিক ইতিহাসের পাঠও।
আরও পড়ুন
প্রবীণদের বাঁচাতে আমেরিকার রাস্তায় টহল তরুণ প্রজন্মের
স্কুল চলার মাঝেই কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন চাষের জমিতে। আবার ফিরে আসছেন কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। শিক্ষকদের সঙ্গেও গড়ে উঠেছে এক মধুর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এ যেন এক সব পেয়েছির পরিবেশ। এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ কোভিডমুক্ত থেকে ইতিমধ্যেই রেকর্ড করেছে মণিপুরের এই গ্রাম। এবার নতুন করে অশিক্ষা দূরীকরণের মধ্যে দিয়ে আরও এক রেকর্ড গড়ার পথেই হাঁটছে চাট্রিক খুলেন। আর মণিপুরের এই মডেল যে গোটা ভারতের কাছেই এক দৃষ্টান্ত, তাতে আর নতুন করে বলার নেই কিছুই…
আরও পড়ুন
লকডাউনে স্তব্ধ রাজ্য, বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষদের সাহায্যে এগিয়ে এলেন যাঁরা
Powered by Froala Editor