মণিপুরের সবচেয়ে বড়ো উৎসব ইয়াওসাং। ৫ দিন ধরে এই উৎসবের সবচেয়ে বড়ো উদযাপন হয় খেলার মাঠে। সেখানে মুছে যায় লিঙ্গের বৈষম্যও। একসঙ্গে নানা ধরনের খেলায় মেতে ওঠেন পুরুষ এবং মহিলারা। কিন্তু সত্যিই কি মুছে যায় লিঙ্গবৈষম্য? কয়েক বছর আগে এই কথাটাই ভাবছিলেন সাদাম হানজাবাম (Sadam Hanjabam)। পুরুষ এবং মহিলারা খেলায় মেতেছেন। কিন্তু যাঁরা এই দুই লিঙ্গের মধ্যে পড়েন না? সেই এলজিবিটিকিউ (LGBTQ) কমিউনিটির মানুষদেরও খেলায় সামিল করে নিতে চাইলেন তিনি। আর এভাবেই ২০১৮ সালে জন্ম নিয়েছে ভারতের প্রথম এলজিবিটিকিউ ফুটবল টিম। ২ বছরের চেষ্টায় তার সদস্য সংখ্যাও ৬ থেকে বেড়ে ১৫ ছাড়িয়েছে। এই স্বপ্নের নির্মাণের পিছনে থাকা মানুষটির জীবনও কম বিচিত্র নয়।
ইম্ফল শহরে জন্ম সাদাম হানজাবামের। সীমান্ত থেকে কিছু দূরে ইম্ফল শহর, প্রায় সবসময়ই সেখানে যুদ্ধের পরিস্থিতি লেগে থাকে। বাড়ির সামনে বেশিরভাগ দিনই লাশ পড়ে থাকতে দেখতেন সাদাম। তবে যুদ্ধ কেবল বাইরে নয়, চলছিল তাঁর নিজের ভিতরেও। নিজের লিঙ্গপরিচয়কে সামনে আনার লড়াই। পুরুষ বা মহিলা নন, কুইয়ার হিসাবেই স্বীকৃতি চেয়েছিলেন তিনি। এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবন পৃথিবীর কোনো প্রান্তেই সহজ নয়। মণিপুরের মতো রাজ্যে তো নয়ই। অনেকেই চান, এই রাজ্য ছেড়ে বাইরে চলে যেতে। কিন্তু সেই সুযোগ তো সকলের হয় না। সাদাম যদিও বাইরে চলে যেতে পেরেছিলেন। শিক্ষাসূত্রে প্রথমে কেরালা এবং তারপর মুম্বাই শহরে আশ্রয় নিলেন সাদাম। মুম্বাই শহর ছিল তাঁর কল্পনার শহর। কারণ তিনি শুনেছিলেন সেখানে এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষদের হীন চোখে দেখা হয় না।
তবে তাঁর বাস্তব অভিজ্ঞতা একদমই স্বপ্নের মতো হল না। লিঙ্গপরিচয়ের জন্য মণিপুরে যতটা অপমানিত হয়েছিলেন, তা মুম্বাইতে হতে হয়নি। তবে এখানেও সমস্ত মানুষ যথেষ্ট সচেতন নন। সেইসঙ্গে নতুন যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেন সাদাম, তা জাতিবৈষম্য। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি থেকে আসা মানুষরা ভারতের বাকি অংশের কাছে চিরকাল বিদ্রূপের শিকার হন। সাদামের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এমনকি নিজের মণিপুরি পরিচয় লোকাতে পদবিও বদলে ফেলেছিলেন সাদাম। তবুও সমস্যার হাত থেকে নিস্তার পেলেন না। এই সময় অবসাদের কারণে নেশায় ডুবে থাকতেন সাদাম। একসময় তা এতটাই বাড়াবাড়ি হয়, হাসপাতালেও ভর্তি হতে হয় তাঁকে। আর তার পর থেকেই শুরু হয় অন্য এক লড়াই।
এক মনস্তাত্ত্বিকের পরামর্শে এলজিবিটিকিউ মানুষদের নিয়ে নতুন কিছু করার পরিকল্পনা নিলেন সাদাম। ২০১৭ সালে তৈরি করলেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, ইয়া-আল। মণিপুরী ভাষায় যার অর্থ বিপ্লব। ২০১৮ সালে সত্যিই বিপ্লব ঘটিয়ে ফেললেন তাঁরা। ইয়াওসাং উৎসবে শুরু হল কুইয়ার স্পোর্টস ফেস্টিভ্যাল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণতা পেল দেশের প্রথম এলজিবিটিকিউ ফুটবল টিম। তবে এখানেই শেষ নয়। পাশাপাশি এইডস প্রতিরোধের বার্তা, কন্ডোম এবং স্যানিটারি প্যাডের ব্যবহারের মতো বিষয় নিয়েও সচেতনতা তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে ইয়া-আল। আর অবশ্যই উত্তর-পূর্বের মানুষদের নিয়ে যে জাতিবিদ্বেষী মানসিকতা ছড়িয়ে রয়েছে দেশজুড়ে, তার বিরুদ্ধেও সরব তাঁরা। গত অতিমারীর সময়েও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কোভিড আক্রান্তদের সাহায্যের কাজ করে গিয়েছেন এলজিবিটিকিউ মানুষরা। সাদাম বলেন, তিনি এখনও নেশায় আসক্ত। তবে এই নেশা সমাজের প্রচলিত চেহারাটাকে বদলে ফেলার নেশা।
আরও পড়ুন
স্কুলের পাঠ্যক্রমে এলজিবিটিকিউ ইতিহাস, বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে নজির স্কটল্যান্ডের
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
আফগানিস্তানের এলজিবিটি সম্প্রদায়ের জন্য লড়ছেন নেমাত সাদাত, সাক্ষী কলকাতাও