২০১৩ সাল। কলকাতার হুগলি নদীর তীরে সমীক্ষা করতে গিয়েই আশ্চর্য এক দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিলেন ডঃ পুনর্বসু চৌধুরী এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের একটি দল। কলকাতার মতো শহরে, গঙ্গা তীরবর্তী অঞ্চলে ইতিউতি গজিয়ে উঠেছে ম্যানগ্রোভ গাছ। হ্যাঁ, চমকে ওঠার মতোই ব্যাপার বটে। সাধারণত নদীর ব-দ্বীপ অঞ্চলে এবং মোহনার কাছাকাছিই দেখা যায় ম্যানগ্রোভের উপস্থিতি। তাহলে কলকাতায় (Kolkata) কীভাবে এসে হাজির হল ম্যানগ্রোভ (Mangroves Tree)?
বিজ্ঞানের পরিভাষায় এই আশ্চর্য ঘটনাটির নাম ম্যানগ্রোভ মাইগ্রেশন। সর্বপ্রথম ভারতে চিহ্নিত করা হলেও, পরবর্তীতে মেক্সিকো, লুইসিয়ানা, অস্ট্রেলিয়া, ফ্লোরিডাতেও দেখা গেছে এধরনের ম্যানগ্রোভ মাইগ্রেশনের ঘটনা। কিন্তু কী কারণে ক্রমশ ব-দ্বীপ বা মোহনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ম্যানগ্রোভ? পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রে কতটা প্রভাব পড়বে এই ঘটনার?
২০১৫ সালে এ-সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই গঙ্গাবক্ষে নেমেছিলেন গবেষকরা। গঙ্গাসাগর থেকে শুরু করে ত্রিবেণী— দীর্ঘ ৭ মাস ধরে নৌকায় চেপে সমীক্ষা চালান গঙ্গার ১৮০ কিলোমিটার বিস্তৃত দক্ষিণ প্রবাহে। তথ্যসংগ্রহ করেন ম্যানগ্রোভের অভিযোজন এবং ঘনত্ব বৃদ্ধি সম্পর্কে। আর তাতেই উঠে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ন, বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থার অভাব— ইত্যাদি একাধিক কারণের জন্যই প্রভাবিত হচ্ছে ম্যানগ্রোভ অরণ্য। পাশাপাশি এই বদলের পিছনে রয়েছে হুগলি নদীর জলের রাসায়নিক মান পরিবর্তনের ঘটনাও।
একটু খুলে বলা যাক ব্যাপারটা। নদীর মিষ্টি জল সমুদ্রের লবণাক্ত জলের সঙ্গে যেখানে মিশ্রিত হয়, সেখানেই গড়ে ওঠে ম্যানগ্রোভ। গঙ্গার ক্ষেত্রেও মূলত গাঙ্গেয় ব-দ্বীপ অঞ্চলেই তাই দেখা যায় ম্যানগ্রোভ অরণ্য। তবে মানুষের কার্যকলাপের ফলে ক্রমে বদলাচ্ছে গঙ্গার চরিত্র। বাংলার মূর্শিদাবাদের কাছে দুটি অংশে ভাগ হয়ে যায় গঙ্গা— মূল স্রোত চলে যায় পদ্মায় এবং শাখানদী ভাগীরথী নাম নিয়ে নেমে আসে পশ্চিমবঙ্গে। তারপর জলঙ্গি নদী ভাগীরথীতে মেশার পর এই নদীর নাম হয় হুগলি নদী। এই হুগলি শাখাটি প্রবাহিত হয় কলকাতার ওপর দিয়ে। সাধারণভাবে জোয়ার-ভাটা খেলার জন্য হুগলি নদীর জল পদ্মার থেকে বেশি লবণাক্ত। অন্যদিকে পদ্মার জল তুলনামূলকভাবে মিষ্টি।
১৯৭৫ সালে ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণের পর জলের এই গুণমানেই বড়ো বদল লক্ষ করা যায়। উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায় হুগলির জলের লবণাক্ততা। আর সেই কারণেই ক্রমে লবণাক্ত ও মিষ্টি জলের মিশ্রণস্থল নদীর মোহনা থেকে অভ্যন্তরে ঢুকে আসছে ক্রমশ। ফলে কলকাতা ও কলকাতা সংলগ্ন অঞ্চলে তুলনামূলক কম লবণাক্ত মাটিতে জন্মানো ম্যানগ্রোভ গাছ বংশবিস্তার করতে পারছে স্বকীয়ভাবে। একইসঙ্গে অপরিকল্পিত উন্নয়ন, শিল্প ও কলকারখানার বিকাশ, পর্যাপ্ত জল নিষ্কাশন এবং বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থার অভাবের কারণে ক্রমে ক্ষতিকর ধাতুর উপস্থিতিও বাড়তে থাকে হুগলির জলে। যা পুষ্টি যোগাচ্ছে ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদদের।
তবে কলকাতায় ম্যানগ্রোভের উপস্থিতি মোটেই ইতিবাচক দিক নয় বলেই দাবি বিজ্ঞানীদের একাংশের। তার কারণ, কলকাতায় খুঁজে পাওয়া সোনেরটিয়া গোত্রের ম্যানগ্রোভের উপস্থিতি নির্দেশ করে জলের সিওডি স্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমশ। অর্থাৎ, দূষণজনিত কারণে প্রভাবিত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বাস্তুতন্ত্র। অক্সিজেনের মাত্রা কমছে জলের। পাশাপাশি মোহনায় জলের মান পরিবর্তনের কারণে, ব-দ্বীপ ছেড়ে ক্রমশ মূল অববাহিকায় ছড়িয়ে পড়বে ম্যানগ্রোভ— থাকে সেই সম্ভাবনাও। আর তেমনটা হলে, পরবর্তীতে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা হারাবে উপকূলবর্তী অঞ্চল। প্রভাবিত হবে কৃষিকাজ এবং পর্যটন-সহ একাধিক ক্ষেত্র। ক্ষতিগ্রস্ত হবে সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রও। সবমিলিয়ে ম্যানগ্রোভদের এই অভিবাসন যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে সিঁদুরে মেঘের…
Powered by Froala Editor