মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়(১৯৩৮-২০২০)–এর স্বপ্ন ও গন্তব্য

নির্দোষ ঠাট্টাই বলা চলে। অনেকটা সমীহ-ও ছিল। সহজীবী অধ্যাপক-অনুবাদককে নিয়ে জনৈক কবি একদা মন্তব্য করেন, ‘ভাস্কো পোপা! ...এই নামে আবার কবি হয় নাকি? ওসব মানব (মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়) বাড়িতে বসে বানায়। অবাক কাণ্ড কী জানো, সেই লোকগুলোই দেখি কয়েক বছর পর নোবেল প্রাইজ পেয়ে যায়!’

শুধুই ভাস্কো পোপা নন। মানববাবু চিনিয়েছেন আরো অনেককে। মিরোস্লাভ হোলুব, চেসোয়াভ মিউশ, নিকানোর পাররা, ভিসওয়াভা শিমবোর্স্কা, পেটার হান্টকে - কত নাম করব? এবং এর মধ্যে (যাদের নাম এইমাত্র করা হল) সত্যি সত্যিই নোবেল পেয়েছেন তিনজন - মিউশ, শিমবোর্স্কা এবং হান্টকে। একাধিকবার মনোনীত হয়েছেন নিকানোর পাররা, অ্যান্টি পোয়েট্রির যিনি এক পায়োনিয়র। এখানে কবুল করছি, ‘নোবেল প্রাইজ’ পাওয়া/না-পাওয়া তেমন কিছু বিষয় নয়; এই শতকের অনেক মহৎ লেখকই বস্তুটি পাননি (কাফকা, প্রুস্ত, জয়েস, বোর্হেস, উলফ, জীবনানন্দ... তালিকা দীর্ঘ হতেই থাকবে)। তো সে বিতর্ক এখন তোলা থাক; কেননা আর কিছু না পেয়ে শুধু প্রাইজ নিয়েই এত কথা বলছি দেখলে মানববাবু আদৌ প্রসন্ন হতেন না। 

‘অর্ধেক জীবন’ বইতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় জানান, তাঁর একটা ধারণা ছিল বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি বই পড়েছেন - কিন্তু তাঁর ‘ভুল’ ভেঙে গেছিল ‘মানব’কে দেখে। ... এত ধরনের এবং এত জনের লেখা নিয়ে তর্জমায় আগ্রাসী মানববাবু, যে তার বিশালতা কিংবা গুণমান নিয়ে চটজলদি কিছু বলা সত্যিই দুষ্কর। পূর্ব ইউরোপ-লাতিন আমেরিকা কিংবা ভারতীয় প্রাদেশিক সাহিত্য, স্তানিসোয়াভ লেম কি জুল ভার্নের গল্প - ছাড় দেন নি কিছুই। হোলুবের কবিতা যখন ধরেছেন তখন নমুনা হিসেবে খান দশেক কবিতা দিয়ে ক্ষান্ত হননি, তর্জমা করেছেন সাত-সাতটা বই  (‘মিরোস্লাভ হোলুবের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ দ্রষ্টব্য) - একই ডিসিপ্লিন মেনেছেন আলেহো কার্পেন্তিয়ার তর্জমা করতে গিয়েও।  

নিকানোর পাররা-র সঙ্গে দেখা হয়েছিল ভূপালে-র আন্তর্জাতিক কবি সম্মেলনে। বাংলায় তর্জমা হবে শুনে পাররা কবিতাগুলি বেছে দেন নিজেই, যে তথ্য মানববাবুই আমাদের দিয়েছেন ‘নিকানোর পাররার শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইয়ের ভূমিকায়। ...সিনসিয়ারিটি- শব্দটির ঠিক বাংলা কী হবে জানি না, এটুকু জানি এই নিয়ে অনুবাদক হিসেবে মানববাবুর জুড়ি বাংলা ভূখণ্ডে আছেন বলে খবর নেই।

পাঠকদের আরো জানাই; তাদেউশ রুজেভিচের পূর্ণাঙ্গ বই ‘নরখাদকের উদ্দেশে চিঠি’, হুয়ান রুলফোর সমগ্র সাহিত্য (‘পেদ্রো পারামো’ – উপন্যাস, ‘জ্বলন্ত প্রান্তর’ – গল্পগ্রন্থ),  মার্কেসের নভেলা ‘কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না’ কিংবা গল্পগ্রন্থ ‘সরলা এরেন্দিরা ও তার নিদয়া ঠাকুমার অবিশ্বাস্য করুণ কাহিনী’, পোলিশ কল্পবিজ্ঞান লেখক লেম-এর যুগ্ম-নভেলা ‘মুখোশ ও মৃগয়া’ এবং একটি গল্পগ্রন্থ ‘পৃথিবী কী ভাবে বাঁচল’- প্রতিটি বইয়ের পেছনে আছে এনার নাছোড় শ্রম।

বলে শেষ করা যাবে না। ...‘এই স্বপ্ন! এই গন্তব্য!’ নামে লাতিন আমেরিকান কবিতার যে-সংকলন (কেবল এই বইটির জন্যেই একজন অনুবাদক স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারেন), তৃতীয় বিশ্বের লেখা নিয়ে অনুবাদ ও সম্পাদনার কাজ ‘হরবোলা’, সাদত হসন মান্টো প্রমুখের তর্জমা নিয়ে খণ্ডে খণ্ডে সম্পাদিত ‘ভেদ-বিভেদ’ -  দানবিক ছাড়া একে আর কী বলা যায়? ...প্রাবন্ধিক হিসেবে ছিলেন পয়লা শ্রেণির, ‘আত্মহত্যার অধিকার’ কিংবা ‘শার্ল বোদলেয়ার ও বাংলা কবিতা’-র মতো প্রবন্ধ –গদ্যই বলুন কিংবা বক্তব্য – উভয় দিক থেকেই এরা তুঙ্গ। হুয়ান রুলফো-র ‘জ্বলন্ত প্রান্তর’ বইয়ের যে ভূমিকা – ‘হুয়ান রুলফো-র স্থাণুজগৎ’ কিংবা ‘ভাস্কো পোপার শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বইয়ের পরিশিষ্ট – ‘আগুন নিয়ে খেলা’, তাদেরই বা বাদ দিই কী ক’রে? ... শিশু-কিশোর সাহিত্য নিয়ে ছিল ব্যাপক উৎসাহ, সুকুমার রায় কিংবা ত্রৈলোক্যনাথকে নিয়ে লেখাগুলি কেউ চাইলে পড়তে পারেন (‘আত্মহত্যার অধিকার ও অন্যান্য সনদ’ গ্রন্থে লভ্য)।

আরও পড়ুন
প্রয়াত অনুবাদক মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্য হারাল আরও এক নক্ষত্রকে

এক যন্ত্রমানবীর আত্মকথনে বিবৃত ‘মুখোশ’ নভেলেট লিখেছিলেন পোলিশ কল্পবিজ্ঞান লেখক স্তানিসোয়াভ লেম (১৯২১-২০০৬)। মানববাবুর অনুবাদ থেকে তারই একটু উল্লেখ করছি, লেখাটি যেখানে ফুরিয়ে আসছে –

...‘সে আরো একবার কাৎরালো, তারপর তার আর নিঃশ্বাস পড়লো না, আর তখন, শুধু তখন, যখন আমার মন অবশেষে বিশ্রাম পেল, শান্তি পেলো, আমি আস্তে গিয়ে তার পাশে শুয়ে পড়লুম, আমার বাহুতে জড়িয়ে ধরলুম তাকে, ঢেকে দিলুম তার শরীর, আর এইভাবেই শুয়ে রইলুম আমি, আলোয় আর অন্ধকারে, আর দু-দিন ধ’রে হাহাকার করলো তুষারঝড়, শুধু হাহাকার, আর শেষে এই তুষারই ঢেকে দিলো আমাদের বাসরশয্যা, এমন-এক কাফনে যেটা আর গললো না।

আর, তৃতীয় দিনে, উঠে এল সূর্য।’   

আরও পড়ুন
করোনা কেড়ে নিল প্রাণ, প্রয়াত মারাঠি সাহিত্যিক রত্নাকর মাটকারি

সন্দেহ নেই, লেম-এর ফিকশনে যা ছিল – সেই অপূর্ব গদ্য অনুবাদেও অক্ষুণ্ণ আছে। সবিনয়ে জানাই, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন কবি এবং তাঁর আগুন চাপা থাকেনি। 

প্রথম বিশ্বের কাছেই সমূহ ক্ষমতা ও পুঁজি, সাহিত্য-শিল্প যে তাদেরই একচেটিয়া হবে তাতে আর আশ্চর্য কী। উপনিবেশবাদের যুক্তি তাই বলে। ...বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা কিংবা সাহিত্য পড়ানোর কাজেই মানববাবু তুষ্ট থাকেন না - আমরা আন্দাজ করতে পারি তাঁর ভেতরে কোথাও একটি হেমারেজ চলেছিল যে-অসুখ থেকে তিনি অনবরত খুঁজে গেছেন ‘অন্য’ কিছু – তা থাকতে পারে তৃতীয় বিশ্বের রূপকথায়, জাদুবাস্তব আখ্যানে... প্রতিকবিতায় কিংবা জঁর-সাহিত্যে। বিভাষার দেওয়ালে কান পেতে তাই কিছু শোনার চেষ্টা, ইশারা ক’রে চিনিয়ে দেওয়া তাকেই! 

যদি চিনতে পারি ইশারা, যদি দেওয়ালে পাতি কান - কী শুনতে পাব?  হয়তো একটি অমার্জিত অন্তেবাসী কণ্ঠ, হয়তো চায়ের কেৎলির তীক্ষ্ণ শিস ...যখন ঘুম ভেঙে উঠেছে তরবারির মতো নাঙা কেউ, যখন প্রাতরাশের টেবিলে অপেক্ষা করছে খবরের কাগজ – দৈনন্দিন, সহজ, তথ্যময়; যেমন তরো হতে চেয়েছিল হোলুব বা হান্স মাগনুস-এর কবিতাও।  

আরও পড়ুন
চলে গেলেন বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক ও সাহিত্যিক ডঃ আনিসুজ্জামান

কেউ যাঁকে চিঠি লেখে না তাঁরই স্ত্রী ধৈর্য হারিয়ে যখন জিজ্ঞেস করেন, ‘ততদিন আমরা খাবো কী?’ তখন যে-প্রাঞ্জলতা নিয়ে পঁচাত্তর বছরের অপরাজেয় কর্নেল একটি শব্দে উত্তর করেন, ‘গু’;  যে-‘গভীর প্রত্যয়’ থেকে ফিদেল কাস্ত্রো একদা বলতে পারেন, ‘অস্ত্রের চেয়ে মতাদর্শ অনেক শক্তিশালী’... অনূদিত কবিতা-সংকলন ‘এই স্বপ্ন! এই গন্তব্য!’-এর ভূমিকায় একই আবেগ থেকে লেখেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় – ‘কেননা স্বপ্ন ও গন্তব্য সকলেরই এক – কী শ্রমিকের, কী শিল্পী-সাহিত্যিকের, কী বুদ্ধিজীবীদের।’

Powered by Froala Editor