বয়স পঞ্চাশোর্ধ্ব। এই বয়সেও লাল লিপস্টিক? সন্তান থাকার পরেও এই ধরণের ‘আতিশয্য’ গূঢ় অন্যায়। আর সেই কারণেই হেনস্থা হতে হয়েছিল আত্মীয়দের কাছেই। সামনাসামনি নয়, লোকচক্ষুর আড়ালেই চলেছিল চর্চা। এহেন প্রসাধনী দ্রব্যের ব্যবহারের জন্য কটু কথা বলতেও পিছপা হননি প্রিয়জনেরা। মায়ের সেই অপমানেই অভিনব প্রতিবাদ জানালেন কলকাতা-নিবাসী পুষ্পক সেন। সম্প্রতি তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করলেন নিজের লাল লিপস্টিক পরিহিত ছবি।
“উনি সাজতে ভীষণই ভালোবাসেন। কিন্তু লাল লিপস্টিক পরার শখ থাকলেও এর আগে কোনোদিন তিনি পরেননি। সম্প্রতি পারিবারিক এক অনুষ্ঠানে এই লিপস্টিক ব্যবহারের জন্যই নিকটতম কিছু আত্মীয়রা কুমন্তব্য করেন। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার, এঁরাই সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘আধুনিক’ হওয়ার জন্য বিভিন্ন পোস্ট লিখে থাকেন। কিন্তু তাঁরাও এই আলোচনায় অংশ নিলেন বিনাদ্বিধায়”, বিস্তারিতভাবে ঘটনাটি জানালেন পুষ্পকবাবু।
চাইলেই সরাসরি ঝগড়া করতে পারতেন তিনি, অথবা এড়িয়ে যেতে পারতেন এই মন্তব্যকে। তবে তাতে কি বদলাবে মানসিকতা? তাই প্রতিবাদের রাস্তাকেই বেছে নিলেন তিনি। “লিপস্টিক একটা প্রসাধনী দ্রব্য, একটা রং। সেটা কখনোই একজনের চরিত্রকে উপস্থাপন করতে পারে না। সেখান থেকেই এই ছবিটা পোস্ট করা। একটা বার্তা পৌঁছে দেওয়া এই ধরণের চর্চাকে আমি গ্রাহ্য করছি না। বরং আমি আমার মা এবং এই মানসিকতার শিকার হওয়া অন্য সকলের পাশে দাঁড়াচ্ছি”, বলছিলেন পুষ্পকবাবু।
এই ঘটনা একরকম ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপই বটে। সমাজই যেন ঠিক করে দিচ্ছে কার কোন পোশাক পরা উচিত, কাকে সাজতে হবে কেমনভাবে। একুশ শতকে দাঁড়িয়েও খোদ কলকাতার বুকেও জাঁকিয়ে আছে রক্ষণশীল মানসিকতা। আর প্রান্তিক অঞ্চলের কথা নয় নাই বলা হল। বাংলা তো বটেই, সারা দেশেই প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে এমন অসংখ্যা হেনস্থা, অপমানের ঘটনা। তবে তা নিয়ে সাড়া পড়ছে না তেমন। সামাজিক চাপই যেন জোর করে কণ্ঠরোধ করে দিচ্ছে স্বাধীনতার। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা প্রতিবাদই কি যথেষ্ট এই বদ্ধমনস্কতাকে পরিবর্তন করে ফেলতে?
পুষ্পকবাবু জানালেন, “আমি এটা একদমই প্রত্যাশা করি না, এই পোষ্টের পরই সকলের এসে ক্ষমা চাইবে আমার থেকে। বা একেবারেই মুছে যাবে এই মানসিকতা। তবে আমি এই বার্তাটা দিতে চেয়েছি যে এই ধরণের মন্তব্যের তোয়াক্কা করি না। এবং সেটা উচিতও নয়। এসবের পরও আমার যেটা ভাল্লাগবে, তেমনটাই সাজব আমি।”
পুষ্পকবাবুর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট রীতিমত ভাইরাল হয়ে যায় মুহূর্তের মধ্যে। এসেছিল দু’ধরণের মন্তব্যই। একাংশ পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর। আবার কেউ কেউ তুলেছেন সংস্কৃতি বিকৃতির অভিযোগ। কিন্তু সত্যিই কি সংস্কৃতি বেঁধে দিচ্ছে আমাদের? প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ঘাঁটলে মহিলাদের পাশাপাশি পুরুষদের প্রসাধনীর ব্যবহার এবং সাজ-সজ্জারও উদাহরণ পাওয়া যায়। সেই কথাই উঠে এল তাঁর বক্তব্যে, “এটা নতুন কিছু নয়। রাজারাও ব্যবহার করতেন এই ধরণের সামগ্রী। আমি শুধু সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিচ্ছি। কেউ এই বিষয়টি পছন্দ না-ই করতেই পারেন। তাঁর পূর্ণ স্বাধীনতা আছে ব্যবহার না করার। তবে সেটার জন্য যেন ব্যক্তিগতভাবে কাউকে আঘাত না করা হয়। ভিন্নমত নিয়েও কো-এক্সিস্ট করাটাই আমাদের সকলের উচিত।”
আরও পড়ুন
সমাজের গালে থাপ্পড় মারতে কার্টুনই হাতিয়ার গগনেন্দ্রনাথের
সমাজের চোখে আঙুল দিয়েই তার বিকৃত মানসিকতাকে দেখিয়ে দিয়েছেন পুষ্পক সেন। নিঃশব্দ প্রতিবাদের ভাষা রেখেছেন সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে। এখন দেখার সেই প্রতিবাদ কতটা বদলে দিতে পারে মানুষকে। তার প্রভাব কতটা নাড়িয়ে দিতে পারে এই মেকি উদার-মনস্কতাকে। সে উত্তর অবশ্য সময়ই বলবে...
Powered by Froala Editor