সঙ্গী কুকুর, ৭ বছর পায়ে হেঁটে বিশ্বভ্রমণ তরুণের

দিনটা ছিল ২০১৫ সালের ২ এপ্রিল। ২৬ বছরে পা দিতে তখনও বেশ কয়েক ঘণ্টা বাকি তাঁর। ছোট্ট ঠেলাগাড়িতে কয়েকটি জামাকাপড়, কিছু শুকনো খাবার, টেন্ট, টর্চ, ল্যাপটপ, ক্যামেরা ও হাইকিং-এর কিছু সামগ্রী নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। দু’চোখে বিশ্বভ্রমণের স্বপ্ন। 

সাত বছর পর সেই স্বপ্নপূরণ করে এবার দেশে ফিরলেন মার্কিন যুবক টম টারসিচ (Tom Turcich)। পায়ে হেঁটেই অতিক্রম করলেন ৪৮ হাজার কিলোমিটার পথ। বিশ্বের দশম ব্যক্তি হিসাবে পদব্রজে বিশ্বভ্রমণ করে তৈরি করলেন এক নতুন নজির। তবে এই অ্যাডভেঞ্চারে একা ছিলেন না টম। সঙ্গী ছিল তাঁর পোষ্য সারমেয় ‘সাভান’। টম বিশ্বের দশম ব্যক্তি হলেও, কুকুর হিসাবে প্রথম এহেন অভিযান করে গিনেস বুকে নাম তোলার অপেক্ষায় রয়েছে পোষ্য চতুষ্পদটি। 

তবে নিছক বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়া নয়। প্রিয়জনের আকস্মিক মৃত্যুই টমকে ভাবিয়ে তুলেছিল এই বিশ্বভ্রমণের সম্পর্কে। অ্যান মেরি। ২০০৬ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে জেট-স্কি দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন তাঁর এই ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। টম উপলব্ধি করেছিলেন, সময় ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। হয়তো কাল হঠাৎ এই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে তাঁকেও। নিজের অজান্তেই। তার আগে এই দুনিয়ায় নিজের ছাপ রেখে যেতে চেয়েছিলেন টম। দীর্ঘ ৮ বছর ধরে চলেছে তাঁর সেই পরিকল্পনা। স্নাতক স্তরে পড়াশোনা করার সময় থেকেই কাজ করতেন টম। আয়ের সবটাই তিনি জমিয়ে রেখেছিলেন বিশ্বভ্রমণের জন্য। যদিও সেই টাকায় গোটা পৃথিবী ঘুরে দেখা যায় না কোনোভাবেই। শেষ পর্যন্ত ২০১৫ সালে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে এগিয়ে আসেন নিউ জার্সিরই এক উদ্যোগপতি। 

শুরুতে অনন্তের পথে একাই পাড়ি দিয়েছিলেন টম। তবে চার মাস পরেই নিঃসঙ্গতা চেপে বসে তাঁর উপর। পাশাপাশি পথে-ঘাটে বিপদের আশঙ্কা তো রয়েছেই। অরণ্যে ক্যাম্প করে শোয়ার সময়ও ঘুমাতে পারতেন না তিনি। বন্যপ্রাণী যদি আক্রমণ করে! এইসব কথা ভেবেই পানামার একটি আশ্রয়কেন্দ্র থেকে সাভানাকে দত্তক নেন টম। তখন তার বয়স মাত্র ২ মাস। কয়েক সময় সাভানাকে কার্টে চাপিয়েই হেঁটেছেন টম। তারপর সেও হয়ে উঠে তার মালিকের মতো পুরোদস্তুর অভিযাত্রী। 

আরও পড়ুন
পায়ে হেঁটে বিশ্বভ্রমণ, অনন্য নজির মার্কিন তরুণীর

উত্তর ও দক্ষিণ আফ্রিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ, এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া— ছটি মহাদেশই পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন টম। বোটে চেপে ছুঁয়ে গেছেন আন্টার্কটিকাও। কখনও পড়তে হয়েছে ডাকাতের খপ্পরে, আবার আজারবাইজান কিংবা কাজাখস্তানে রীতিমতো আপ্যায়নও পেয়েছেন স্থানীয় বিয়েবাড়িতে। সেইসঙ্গে বিশ্বের প্রথম ব্যক্তি হিসাবে তুরস্কের বসফরাস সেতু পায়ে হেঁটে পার হওয়ার স্বীকৃতিও পেয়েছেন তিনি। সবমিলিয়ে সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। টমের লক্ষ্য ছিল ঠিক সাড়ে পাঁচ বছরের মধ্যে তাঁর বিশ্বভ্রমণ সেরে দেশে ফেরা। তবে বাধ সাধে করোনা মহামারী। সে-সময় দীর্ঘদিন যুদ্ধবিধ্বস্ত আজরবাইজানে আটকে থাকতে হয়েছিল তাঁকে। পাশাপাশি চিন, ভারত-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে প্রবেশাধিকারও পাননি টম। বাধ্য হয়েই তাঁকে উড়ে যেতে হয় অস্ট্রেলিয়ায়। ফলে সবমিলিয়ে তাঁর সময় লেগে যায় সাত বছর। 

আরও পড়ুন
৬৭ বছর বয়সে সাঁতার কেটে বিশ্বভ্রমণ! ঘোষণা স্লোভানিয়ান সাঁতারুর

সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন টম। ফিরে খানিকটা অবাকই হয়েছেন তিনি। এতদিন তিনি ভেবে এসেছিলেন এই লড়াই তাঁর একার। তবে নিজের শহরে ঢুকতেই বদলে যায় পরিস্থিতি। তাঁর বহু বন্ধু, আত্মীয় এবং প্রতিবেশীরা শেষ দু-মাইল পথ হাঁটলেন তাঁর সঙ্গেও। কমতি ছিল না উদযাপনেও। অবিশ্বাস্য এই অ্যাডভেঞ্চারের পর আবার প্রথাগত জীবনে ফিরবেন বলেই জানাচ্ছেন ৩২ বছর বয়সি তরুণ মার্কিনি। টম টারসিচের এই গল্প যেন মনে করিয়ে দেয় টম হ্যাঙ্কস অভিনীত ফরেস্ট গাম্প চরিত্রটির কথাই…

আরও পড়ুন
লকডাউনেই স্বপ্নপূরণ, ছোট্ট বোটে চেপে বিশ্বভ্রমণ হাঙ্গেরির পরিবারের

Powered by Froala Editor