কলম্বিয়ার বোগোতা শহর। এই শহরের বুকেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি লাইব্রেরি। গেটের মাথায় বড়ো করে পোস্টার সাঁটা ‘স্ট্রেন্থ অফ ওয়ার্ডস’। দেখে আর পাঁচটা বাড়ির থেকে লাইব্রেরি বলে পৃথক করা যাবে না এই বাড়িটিকেও। তবে একবার এই গ্রন্থাগারের ভেতরে ঢুকে পড়লেই চমকে উঠবেন যে কেউ। দাঁড়ানোর জায়গাটুকুও নেই। পুরো লাইব্রেরি জুড়েই ঠেসে ভর্তি করা আছে বিভিন্ন স্বাদের বই। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, পাঠ্যবই— সবকিছুই। তবে আলাদা আলাদা করে সাজানো নেই তাদের। কষ্ট করে নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে নিজের চাহিদার বইটি। আর খুঁজে না পেলে দ্বারস্থ হতে হবে লাইব্রেরির কর্ণধারের কাছে। স্বয়ং ত্রাতা হয়ে তিনিই বার করে দেবেন বইটি।
হোসে আলবার্তো গুতেরেজ। তিনিই কলম্বিয়ার এই গ্রন্থালয়ের কর্ণধার। নিজের বাড়িতেই এমন অভিনব গ্রন্থালয় বানিয়ে ফেলেছেন হোসে। আর নিজের বানান এই গ্রন্থালয়কে হাতের তালুর মতোই চেনেন তিনি। জানেন এই স্তুপের মধ্যে কোথায় লুকিয়ে রয়েছে কোন বই। সব মিলিয়ে কুড়ি হাজারেরও বেশি বই রয়েছে তাঁর এই গ্রন্থাগারে।
পেশায় একজন সাফাইকর্মী হোসে। ব্যক্তিগত জীবনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডিও পেরনো হয়নি তাঁর। তবে বইয়ের প্রতি তাঁর টান ছিল চিরকালই। আর সেখান থেকেই প্রায় দুই দশক আগে শুরু হয়েছিল তাঁর এই উদ্যোগ। বোগোতা শহরের ডাস্টবিন পরিষ্কারের সময় হোসে খুঁজে পেয়েছিলেন টলস্টয়ের উপন্যাস অ্যানা ক্যারেনিনা’র একটি অনুলিপি। জঞ্জালের স্তুপ থেকে সেটিকে উদ্ধার করে এনে তিনি জায়গা করে দেন নিজের বাড়িতে। তারপর শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এভাবেই তিনি সংগ্রহ করতে থাকেন একাধিক গ্রন্থ। গড়ে তোলেন সম্পূর্ণ একটি কমিউনিটি লাইব্রেরি।
কোনো বইয়ে হয়তো মুড়ে গেছে পাতাগুলি, কোনোটা জলে ভিজে হলুদ হয়ে গেছে বা ছিঁড়ে গেছে পাতা। তবু সযত্নেই তাদের লালন করেন হোসে। পাঠকদের বিনামূল্যে এই গ্রন্থাগার ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয় আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া দরিদ্র পড়ুয়াদের জন্য বাড়িতেও বই পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন হোসে গুতেরেজ। নিজের বাড়ি ভরাট হয়ে যাওয়ার তাঁর পরবর্তী পরিকল্পনা রয়েছে প্রান্তিক অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রী এবং পাঠকদের জন্য আরও একটি এমন লাইব্রেরি তৈরির।
আরও পড়ুন
৮২ বছর পর বই ফেরাতে হাজির গ্রাহক! তাজ্জব কানাডার লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ
শুধু যে দরিদ্র ছাত্র-ছাত্রীরাই উপকৃত হচ্ছেন তাঁর এই উদ্যোগে, তেমনটা নয়। এই লাইব্রেরির প্রভাবকে ‘মিরাকল’ বললেও কম বলা হবে। কলম্বিয়াতে এখনও বিক্ষিপ্তভাবেই চলছে গৃহযুদ্ধ। জঙ্গলে অবস্থান বজায় রেখেছেন গেরিলা যোদ্ধারা। এমনই একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘ফার্ক’-এর বেশ কিছু যোদ্ধাও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে সংগ্রহ করে গেছেন পাঠ্যবই। কেননা তাঁরাও ফিরতে চান স্বাভাবিক জীবনে। তবে ফিরব বললেই তো ফেরা যায় না। তার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে বিকল্প চাকরির। এমন অবস্থায় হোসে ছাড়া আর কে-ই বা হতে পারে ‘গার্ডিয়ান’?
আরও পড়ুন
বাতিল, ফেলে-দেওয়া বই নিয়েই তৈরি লাইব্রেরি; অভিনব উদ্যোগ তুরস্কের সাফাইকর্মীদের
হোসে নিজেও বিশ্বাস করেন, বই শান্তির প্রতীক। বিশ্বাস করেন, একমাত্র শিক্ষা এবং পঠন-পাঠনের আলোই শান্তি এনে দিতে পারে পৃথিবীতে। হোসের বয়স এখন পঞ্চাশের কোঠায়। আর এই বয়সেই আবার স্কুল জীবনে ফিরেছেন তিনি। নিজের কাজ এবং এই লাইব্রেরির রক্ষণাবেক্ষণ সামলেও চালিয়ে যাচ্ছেন প্রথাগত পড়াশোনা এবং সংগৃহীত বইয়ের পাঠ। শুধু তাঁর লাইব্রেরির উদ্যোগই নয়, হোসে নিজেই যেন হয়ে উঠেছেন অনুপ্রেরণার প্রতীক। আর সে জন্যই হয়তো বোগোতার স্থানীয় মানুষ তাঁকে আখ্যা দিয়েছেন ‘লর্ড অফ দ্য বুকস’…
আরও পড়ুন
সামান্য সাফাইকর্মী থেকে বিমানের ক্যাপ্টেন, নাইজেরিয়ার ব্যক্তির শিখর ছোঁয়ার গল্প
Powered by Froala Editor