উত্তরপ্রদেশের ধর্ষণের ঘটনায় তোলপাড় হচ্ছে সারা দেশ। উত্তরপ্রদেশ সরকারের সঙ্গে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে পুলিশ প্রশাসনকেও। তার সঙ্গেই একযোগে অভিযোগ উঠেছে ভারতীয় সমাজের অন্তর্নিহিত পুরুষতান্ত্রিকতার দিকে। কিন্তু ‘পুরুষতান্ত্রিক’, এই কথাটার ভিতরেই লুকিয়ে আছে ‘পুরুষ’ শব্দটাও। এই পুরুষদের অনেকেও যে ধর্ষণের মতো এই ঘৃণ্য অত্যাচারের শিকার, তা সামনে আসে না অনেক সময়ই। পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে, ভারতে পুরুষদেরও ধর্ষণের সংখ্যা নেহাৎ কম নয়। প্রত্যেক বছরই প্রায় ১৮ শতাংশ পুরুষ কোনো-না-কোনোভাবে ধর্ষিত হচ্ছেন অন্য পুরুষ অথবা মহিলাদের হাতে।
কিন্তু এখানেই প্রথম যে প্রশ্নটা ধাক্কা দিচ্ছে, সেটা হল একজন পুরুষ কী করে ধর্ষিত হতে পারেন? নিজের নির্যাতনের কথা কাউকে জানানোর ক্ষেত্রে এইখানেই আটকে যাচ্ছেন বেশিরভাগ পুরুষ। এবং এর পিছনেও কাজ করছে সেই চিরাচরিত পুরুষতান্ত্রিকতাই। যেন ধর্ষণ করারই অধিকার রয়েছে একমাত্র পুরুষের; কিন্তু মুদ্রার উল্টো পিঠে থাকাও যে তাঁর পক্ষে সম্ভব, সেটা যেন অবিশ্বাস্য এখনও।
রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলের বছর তেইশের এক নির্যাতিতের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পুরুষরাই অনেক সময় জানাতে লজ্জা পাচ্ছেন যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কীভাবে তারা নির্যাতিত হচ্ছেন। সরাসরি ধর্ষিত না হলেও যৌন অত্যাচারের শিকার এক্ষেত্রে তাঁকে হতে হয়েছিল একাধিকবার। একবার পরিবারের মধ্যে থেকেই এবং আরেকবার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীর হাতে। এক্ষেত্রে বাড়িতে অভিযোগ জানিয়েও লাভ হয়নি। বাড়িতে অভিযোগ জানিয়ে যে লাভ হয়নি, এই একই কথা জানাচ্ছেন ডানলপ এবং বাইপাসের কাছে থাকা আরও দু’জন নির্যাতিত পুরুষ। বরং যে-কোনো ভাবে সমগ্র প্রসঙ্গটিকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে পরিবারের মধ্যে থেকেই। সুতরাং মহিলাদের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি আমরা দেখতে পাই, সেই একই ঘটনা যেন সত্যি হয়ে উঠছে এই ক্ষেত্রেও। যিনি ধর্ষিত হচ্ছেন বা অত্যাচারিত হচ্ছেন, এক্ষেত্রে সামাজিক লজ্জায় সমস্ত দায়ভার যেন এসে পড়ছে তাঁর কাঁধেই। উল্টোদিকে ধর্ষণকারীরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে বুক ফুলিয়ে। উত্তরপ্রদেশের সমাজকর্মী বীনা রানার কথার সূত্র ধরে বলা যায়, হয়তো এই ঘটনাই ধর্ষকদের পরবর্তী শিকার খুঁজে নেওয়ার জন্য মনে মনে সাহসী করে তুলছে আরও।
এছাড়াও, এক্ষেত্রে যিনি ধর্ষিত হয়েছেন, তাঁর মানসিক একটি সমস্যা তৈরি হওয়াও এরপর আশ্চর্যজনক কিছু নয়। বরং পুরুষরা নিজেদের শারীরিক ইচ্ছা অথবা ক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য যে-কোনো পন্থাই গ্রহণ করতে পারে, সেই তিতকুটে সত্যিই যেন সামনে আসছে বারবার। কখনও তার শিকার হচ্ছেন মহিলারা, কিংবা, কখনও কখনও পুরুষেরা।
এই ঘটনা যে ধর্ষিত মানুষটির মনে সামাজিক মেলামেশার ক্ষেত্রেও একটা পাঁচিল খাড়া করে দিতে পারে, সেই প্রসঙ্গ উঠে এল অপর দুই নির্যাতিতের মুখেও। এমনকি তিনজনই জানালেন যে, পরবর্তীকালে অন্য কেউ যখন স্বাভাবিকভাবেই তাদের সঙ্গে মিশতে এসেছেন, কখনই প্রাথমিকভাবে খোলা মনে তাদেরকে মেনে নিতে অথবা স্বীকার করতে রীতিমতো অসুবিধা হয়েছে তাঁদের।
সাধারণভাবে এই ক্ষেত্রে পুরুষদের মধ্যে মেয়েলি স্বভাব থাকলে, তাকে দায়ী করার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সেই ধরণের কোনো লক্ষণই ছিল না দক্ষিণ ২৪ পরগনার মহেশতলা অঞ্চলের এক যুবকের। কোচিং থেকে ফেরার পথে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই মুখ চেনা বয়সে বড়ো একজন সাইকেলে করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেছিল তাঁকে। গঙ্গার ধারে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, ডিফেন্সে ছেলেটার ফুটবল খেলা ভাল লাগে তার। তারপরই সন্ধে নামলে আচমকাই জবরদস্তি করতে গিয়েছিল তাঁর সঙ্গে। পুরো ঘটনাটায় যতটা না বেশি রাগ, তার থেকেও বেশি অবাক করেছিল তাঁকে। কিন্তু বাকিদের মতোই, মুখ খোলা হয়নি কখনও। যেভাবে মুখ খুলতে পারছেন না অন্যান্য পুরুষ ‘ভিক্টিম’রাও।
আরও পড়ুন
‘হাথরাসে কোনো ধর্ষণই হয়নি’, খবর ঘোরাতে পিআর এজেন্সিকে বরাত ইউপি সরকারের?
এই ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই জানাচ্ছেন যে পরিবারের পাশে থাকা কতটা প্রয়োজন। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই সহায়তাটুকু বিন্দুমাত্রও পাওয়া হয় না তাঁদের। তাই এক্ষেত্রে কাছের বন্ধুবান্ধব অথবা মনোবিদের সাহায্য হয়ে ওঠে আবশ্যক। বর্তমানে ‘প্রান্তকথা’র মতো বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দাঁড়াচ্ছেন এই সকল নির্যাতিত পুরুষদের পাশে। কিন্তু তবুও এই সংখ্যাটা অত্যন্ত নগণ্য। এদের সহায়তাতেই সাধারণ জীবন যাপনে ফিরে এসে এই নির্যাতিত পুরুষেরা এখন সংকল্প নিয়েছেন, যে কোনোভাবেই হোক তাঁরা পাশে দাঁড়াবেন এইভাবে মানসিকভাবে শেষ হয়ে যেতে থাকা অন্যদের পাশে।
দেখা যাচ্ছে যে, পুরুষদের একটি বড়ো অংশ এই ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তাঁদের ছোটোবেলায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা বুঝে উঠতে পারছেন না যে, ঠিক কী ঘটনা ঘটল তাঁর সঙ্গে। এবং পরবর্তীকালে এই ব্যাপারে তাঁরা কথা বলতে পারছে না সেই প্রথাগত অবিশ্বাসের জায়গাটা থেকেই— কেউ কি আদৌ বিশ্বাস করবে একজন পুরুষের ধর্ষিত হওয়ার ঘটনা? ডানলপের নির্যাতিতের কথায়, তাঁর ছোটোবেলায় বাড়ির কাছের পরিবহন গুমটির একজন অচেনা মানুষ সন্ধের অন্ধকারে জবরদস্তি করেছিল তাঁর সঙ্গে। কিন্তু বয়স বেড়ে যাওয়ার পর তাঁকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক প্রতিবেশীর শিকার হতে হয়েছিল, যাকে সম্পর্কে ‘দাদা’ হিসেবে মানত সে।
পেশায় থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত বাইপাসের ধারের বাসিন্দা যুবক থিয়েটার শেষে বাড়ি ফেরার সময় আক্রান্ত হয়েছিলেন কলকাতার প্রাণকেন্দ্র রবীন্দ্র সদন-রাসবিহারী চত্বরেই। রাস্তা থেকে রীতিমত জোর করে উঠিয়ে নিয়ে গিয়ে শারীরিক নির্যাতন চালানো হয় তাঁর উপর। ঘরভর্তি মদের বোতল। ভয়ে মুখও খুলতে পারেননি তিনি। অবশ্য মুখ খুলে চিৎকার করার মতো পরিস্থিতিও রাখেনি ধর্ষকেরা সেই সময়। সারা গায়ে কালশিটে নিয়ে সে বাড়িতে ফিরতে পারেনি প্রায় দিন তিনেক। কাছের বন্ধুর সাহায্য না পেলে এবং যাদবপুর অঞ্চলের এক মনোবিদ ক্রমাগত তাঁর পাশে না দাঁড়ালে হয়তো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতেই পারতেন না। জোর গলায় তিনি জানালেন, মুখ খোলা দরকার এই ধরনের নির্যাতনের শিকার সকলের। সামনে নিয়ে আসা দরকার এই ধরণের ঘটনায় জড়িত সকল ঘৃণ্য মানুষগুলোকে। নইলে কখনোই এই সমস্যার সুরাহা হওয়া সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন
ধর্ষণ শুধুই যৌনাঙ্গ-নির্ভর নয়; যৌনতার ভাষা শিখতে হবে প্রথমে : মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়
অন্যদিকে, অনেক পুরুষেরই শৈশবে বা কৈশোরে মহিলাদের দ্বারা নির্যাতনের অভিজ্ঞতা আছে। সেক্ষেত্রেও পুরোটা সেই মূহূর্তে বুঝে উঠতে পারেন না তাঁরা। কিন্তু ভবিষ্যতে এই ঘটনা চরম প্রভাব ফেলে তার শরীর এবং মনে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনকি তাঁদের স্বাভাবিক যৌন জীবনও দাঁড়িয়ে যায় প্রশ্নের মুখে। কখনোই এই 'ট্রমা' ঝেড়ে ফেলতে না পারার দরুণ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। কারণ যৌন সংযোগের ক্ষেত্রে সম্মতির কোনো প্রশ্ন সেখানেও থাকে না।
ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ৩৭৫ নম্বর ধারায় পুরুষকে ধর্ষণের ভিকটিম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি এখনও। তাই ধর্ষণকে লিঙ্গ ভিত্তিক না করে, পুরুষদের ধর্ষিত হওয়ার বিষয়টিকেও সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি আইনি স্বীকৃতিও দিতে হবে। এর জন্য একদিকে যেমন আইনে সংস্কার আনা প্রয়োজন, তেমনই দরকার সামাজিক সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানোরও। মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে ক্ষমতার রসায়নটাও অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য একটি বিষয়। বিষয়টি ঘুরেফিরে দাঁড়াচ্ছে সেই ক্ষমতার প্রদর্শনই। অর্থাৎ যে মানুষটি আরেকজন মানুষের উপর চড়াও হচ্ছেন, তিনি কিন্তু তাঁর ক্ষমতার ভাষার অপপ্রয়োগ করছেন। উল্টোদিকে এই ক্ষমতার সিঁড়িতে যিনি অধঃস্তন, তিনি যে লিঙ্গ পরিচয়েরই হোন না কেন, তাঁর বিপন্নতা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। এই যৌন হিংসা আরও অনেক বেশি বিপর্যস্ত করে ফেলতে পারে তাঁকে। এবং সেক্ষেত্রে তিনি একজন নারীই হবেন, এমনটা কিন্তু বলা যায় না। তিনি একজন পুরুষও হতে পারেন, তিনি একজন রূপান্তরকামী মানুষও হতে পারেন।
অনুত্তমার কথাতেও উঠে আসছে সেই পুরুষতন্ত্রের জালে খোদ পুরুষদেরই আটকে পড়ার কথা। পুরুষরা যখন ধর্ষণের বা যৌন হিংসার মুখোমুখি হচ্ছেন, বহুসময় সেকথা উচ্চারণ করা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়ছে তাঁদের জন্য। কারণ, আমাদের সমাজ একটি বিশেষ ধরনের পৌরুষের চর্চায় বিশ্বাসী। তারা মনে করে, যে পুরুষ কোথাও শারীরিকভাবে নিগ্রহের মধ্যে দিয়ে গেলেন বা যৌন হিংসার মধ্যে দিয়ে গেলেন, সেখানেই দাগ লেগে গেল তাঁর পৌরুষে। এটা একটা গ্লানি, দোষ বা লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাঁর জন্য। এই যে ভঙ্গিতে আঙুল উঠছে তাঁর দিকে, অবিশ্বাসের এমন একটা বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে তাঁকে ঘিরে, যা সেই মানুষগুলোকে কুঁকড়ে দিচ্ছে আরও। কুণ্ঠিত করে দিচ্ছে। নিজেদের বিপর্যয়ের কথা বলে উঠতে পারছেন না তাঁরা কিছুতেই।
আরও পড়ুন
ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি কিংবা প্রকাশ্যে শিরশ্ছেদ - পৃথিবীর কিছু দেশে ধর্ষণের শাস্তি এমনই!
তাই যৌন হিংসা আদতে যে লিঙ্গ-পরিচয় নির্ভর নয়, অনুত্তমাও একমত তার সঙ্গে। তাই যেখানেই বা যার সঙ্গেই সেটা ঘটুক বা কেন, তার প্রতিবাদ হওয়া উচিত। প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিৎ। উচিৎ আমাদের মনকেও প্রস্তুত করা, যে আমরা যেন যৌন হিংসাকে কোনো লিঙ্গ-পরিচয়ের আওতায় ফেলে না দেখি। মনে রাখতে হবে, হিংসা বা অপরাধের কিন্তু আসলেই কোনো লিঙ্গ পরিচয় হয় না!
Powered by Froala Editor