এই সেই চেনা আলপথ। আমার খুব ইচ্ছে করছিল, যতদূর যাওয়া যায়, এই আলপথ ধরে হেঁটে যাই। বুজুর্গদের প্রণাম করে এই পথে রেখে যাই আমার পদচিহ্ন।
চেয়ে দ্যাখো, ঘন দুব্বার দল গালিচার মতো এলিয়ে দিয়েছে তার শরীর। শতশত বছর ধরে গাঢ়হরিৎ ওই গালিচার বুকে পদচিহ্ন এঁকে রেখেছে বেবাক মানুষ। ভরা বর্ষায় সারা মাঠ ডুবে গেলে পোয়াতি কাঁকড়া ও শামুকের দল ওই বড়ো আলের কোলেই আশ্রয় নেয়, ডিম পাড়ে, বাচ্চা দেয়। কলিপুকুরের বাঁশঝাড়ের প্রাগৈতিহাসিক আঁধারে সুয্যিমামা যখন অস্ত যায়, তখন হুই মন্দিরসায়রের পাড়ে বেনাঝোপের গর্ত থেকে ধূর্ত শেয়ালেরা সব একে-একে বেরিয়ে আসে। কাঁকড়ার লোভে তারা দল বেঁধে এই আলপথ ঘেঁষে পায়চারি করে। ওদের সমবেত হুক্কাহুয়া শুনে গাঁয়ের ডানপিঠে ছেলের দল মার বুকে মুখ গুঁজে শান্ত বালকের মতো ঘুমিয়ে পড়ে। ছুঁয়ে দ্যাখো, কাঁধে লাঙ্গল নিয়ে এ-পথেই কতদিন হেঁটে গেছে তোমার বাপ-দাদারা। পেটরোগা ছেলেকে কোলে নিয়ে পাড়ার নতুন বউ শাচান পিরের থানে গেছে মানত করতে।
চশমার মোটা কাচের ভিতর দিয়ে য-ত-দূ-র দৃষ্টি যায়, হাতের লাঠি উঁচিয়ে বৃদ্ধ মানুষটি আমাকে নির্দেশ করে বললেন, - এই সেই চেনা আলপথ। এ-পথেই লেখা আছে তোমার ঠিকানা, তোমার কুষ্ঠি-ঠিকুজি।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। যদিও ভরা অঘ্রান তবু শীত এখনও যেন অনাঘ্রাতা। ছেলেবেলায় এই খেতে দাঁড়িয়েই বুকভরে আমি খাস ধানের সুগন্ধ নিতে পারতাম। সেই স্মৃতি মনে আসতেই খুব জোরে একটা নিশ্বাস নিলাম। না, নেই। সেই গন্ধ আমাকে ছেড়ে কবেই চলে গেছে।
চেয়ে দেখি, কাস্তে হাতে ধানের খেতজুড়ে আলপনা এঁকে দিচ্ছে খেতমজুরের দল। ওদের কাস্তে চালানোর একটানা খ্যাস-খ্যাস শব্দে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও, আমার শ্রবণ একস্বরে স্থিত হয়।
ঠিক তক্ষুনি, পাশের খেত থেকে তীব্রস্বরে বেজে উঠল সম্প্রতি শোনা একটি জনপ্রিয় গানের কলি : ‘ও টুম্পা সোনা, দুটো হাম্পি দে না’। দেখি, মোবাইলে গান চালিয়ে নবীন খেতমজুরের দল টুম্পা সোনার ছন্দে মেতে হুস হুস শব্দে এগিয়ে চলেছে। আলপথের পাঁচালি নিয়ে এতক্ষণ যে রোমান্টিকতায় ডুবে ছিলাম, হঠাৎই তার সুর গেল কেটে। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, এখন বেলা এগারোটা। সোনালি রোদ এসে ধানের শীষের থেকে সমস্ত শিশিরবিন্দু কবেই শুষে নিয়েছে। আমার কটস্উল সোয়েটারের তলায়, পিঠে, বগলে, ততক্ষণে ঘাম জমতে শুরু করেছে। উরু খামচে ধরা জিন্সের পকেট থেকে রুমালটা টেনে বের করে কপালের ঘাম মুছলাম। এমন সময় দূর থেকে রানার ডাক শুনতে পেলাম, ---দাদা, চলে আয়, এবার বেরোবো।
কত বছর পর মামার বাড়ি এলাম ঠিক মনে পড়ে না। কিন্তু যা ছেড়ে গিয়েছিলাম --নিকানো উঠোন জুড়ে অবিরাম ঝরে পড়া আমের মুকুল, গোয়ালঘরের মাচায় তুলে রাখা গোরুর গাড়ির মস্ত জোয়াল, এঁদো ডোবাটির জলে ক্ষুধার্ত তেলাপিয়ার বিকট হাঁ-মুখ, ঘরের ঈশান কোণে একখানি গোপন গর্ত ও জমে থাকা ইঁদুরমাটি, চিলেকোঠার কুলুঙ্গিতে লুকোনো দিদিমার আমসত্ত্ব ও আচারের বয়েম --কিছুই তো নেই আর, ফিরে পাওয়ারও নেই কোনো উপায়। মাটির পুরোনো ঘর, উঠোন খামার আর গোয়ালবাড়ি ভেঙে এখন মামাদের নতুন নতুন দালান বাড়ি। আমি আসা ইস্তক এখান-ওখান পালাই পালাই করছি দেখে বড়ো মামি বললেন, - হ্যাঁ রে, এতদিন পর মামার বাড়ি এসে একদণ্ড বসতে ইচ্ছে করে না? খালি এখন ওখান পালাচ্ছিস?
তোমাকে কী করে বোঝাই মামিমা, যে আমি আসলে ফেলে আসা সেই গ্রামটাকে, সেই বাড়িটা খুঁজছি, যাকে কোনোদিনই আর ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। বললাম - এই তো মামিমা, একবার একলখি ঘুরে আসি, সেই ছোটোবেলায় গেছি, তারপর তো দেখাই হয়নি।
- ভাত খাওয়ার আগে তবে চলে আসিস বাবা।
বাইকের পিছনে বসে রানাকে বললাম, - চল একলখি।
একলখি - ইতিহাসের কোন পর্যায়ে, কীভাবে যে তা মানুষের মুখে মুখে তা একলক্ষী বা একলক্ষ্মী হয়ে উঠল, এখন আর কেউ বলতে পারেন না। দ্বারকেশ্বর নদের তীরে অবস্থিত এই সেই প্রাচীন জনপদ, যার শরীরে লিপ্ত হয়ে আছে শত শত বছরের অলিখিত ইতিহাস।
বাঁধ ভেঙে নদী বার বার ভাসিয়েছে পথে, তেমনি নদীবিধৌত উর্বর পললভূমি তাকে বানিয়েছে শস্যসুফলা। দ্বারকেশ্বরের এই অংশকে ঘিরে পুষ্ট হয়েছে কত গ্রাম - পুবে-উত্তরে কেন্দুর, আমড়াইচন্ডি, রাউতাড়া, সরডাঙা, নাগাতেঁতুল, মির্জাপুর। পশ্চিমে আশপুর, পান্ডাহিত, কুমারগঞ্জ, কতাই। মানুষের বানানো আধুনিক ভূগোল এদের কতক হুগলি কতক বর্ধমান জেলার সীমানাভুক্ত করেছে। একলাখি একদিকে যেমন ওই জেলা হুগলি আর বর্ধমানের মিলনস্থল, তেমনি থানা রায়না, ইন্দাস আর মাধবডিহির গা ঘেঁষাঘেষি একলখিকে ঘিরেই।
রানাকে বললাম, চল আগে হাটতলা ঘুরে আসি। আজ অবশ্য রবিবার - হাটবার নয়। ছেলেবেলায় মামার সঙ্গে সাইকেলে চেপে কতবার এসেছি এই একলখির হাট। বাঁশের খুঁটি আর খড়ের চলে ছাওয়া সেসব মেঠো পথের ধুলো এখন আর নেই। বাঁধানো চাতাল আর টিনের চালে ছাওয়া পাকা খুঁটির হাতটলা এখন আর শ্রীহীন নয়। এখনও সোম আর শুক্র - ভোর থেকেই আশেপাশের দশ বিশটা গ্রাম এসে জড়ো হয় হাটতলায়। বড়ো বড়ো ব্যবসায়ী আড়তদারের পাশাপাশি সহায় সম্বলহীন সাধারণ গৃহস্থেরও আশ্রয় এই হাট। ঘরের চালায় ফলানো লাউ, কুমড়ো বা সিম, পুকুরপাড় থেকে তুলে আনা শুশুনি, কলমি আর গন্ধাভাদাল, সঙ্গে পাতিহাঁস আর দেশি মুরগির ডিম ডালায় ভরে নিয়ে হাজির হন কতো প্রবীণ হাটুরে। রানা আমাকে ঘুরিয়ে দেখাল বাঁধানো হাতটলার রকমসকম। অদূরে দ্বারকেশ্বর এই শীতের অঘ্রানে তার ক্ষীণতর স্রোতটুকুও যেন বা হারিয়ে ফেলেছে। নবীন ব্রিজের উপর দাঁড়ালে চরাচরজুড়ে দেখা যায় শুধুই বালুরাশি আর সারিসারি ট্রাক আর ট্রাক্টর। বন্যার ভ্রূকুটি নয়, সুবর্ণবালুকণার জন্যই দ্বারকেশ্বরের যত সুখ্যাতি। এ বালির দানা সাধারণ বালির থেকে সাইজে ঢের মোটা। বাড়ির দেওয়াল প্লাস্টারের পক্ষে তা আদর্শ। বালি মাফিয়াদের কাছে এ নদীর চর তাই সোনার চেয়ে দামি।
নদী ঘুরে রানা আমাকে নিয়ে এল শাচানতলায় - আমার ছেলেবেলার সেই পবিত্র তীর্থস্থান - শাচানপিরের থানে।
বাজারের উত্তরপ্রান্তে ওই যে নিবিড় শ্যামল ছায়াঘেরা বনানী, ওখানেই আছে আরব দেশের আউলিয়া বংশের সুফি সাধক শাহ্ চাঁদ আউলিয়ার মাজার। অনুমান, সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি তিনি জীবিত ছিলেন। দিল্লির সিংহাসনে তখন সম্রাট শাহজাহানের শাসন চলছে। বর্ধমান রাজবাড়ির আদি পুরুষ ঘনশ্যাম রায়ের পিতামহ আবু রায়। সন ১৬৫৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি সম্রাটের ফরমান বলে সরকার সরিফাবাদের অধীনে বাৎসরিক ৫৩২ সিক্কার বিনিময়ে রেকাবিবাজার, মোগলটুলি ও ইব্রাহিমপুরের রাজস্ব আদায়ের চৌধুরী ও নগর কাতোয়ালের পদ পান। আবু রায়ের পুত্র বাবু রায় ১,০০,২৬২ সিক্কার রাজস্ব বন্দোবস্তে বর্ধমান পরগনাসহ আরও তিনটি পরগনার রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব লাভ করেন। এই বাবু রায় ছিলেন বর্ধমান রাজবংশের আদি জমিদার। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের সেই বর্ধমান পরগনা থেকে হুগলির মধ্য দিয়ে মেদনিপুর হয়ে ওড়িশা যাওয়ার যে ঐতিহাসিক পথ - সেই পথেরই এক প্রান্তে অবস্থিত এই একলখি। বর্ধমান থেকে একলখি যাওয়ার সেই পথে গড়ে ওঠা জনপদগুলিকে ঘিরে খনন করা হয়েছিল তিনটি বৃহৎ ঐতিহাসিক দিঘি - সিপ্টা, মোগলমারি আর উচালনের দিঘি। ভাবছিলাম, বর্ধমান শহর থেকে বত্রিশ কিমি, উচালন থেকে মাত্র নয় কিমি দূরে হিন্দু জনগোষ্ঠী দিয়ে ঘেরা নদীবিধৌত এই নিরাপদ জনপদ - একলাখির সন্ধান শাহ্ চাঁদ কীভাবে পেলেন?
হয়তো কোনো এক গ্রীষ্মের তপ্তবিকেলে দ্বারকেশ্বরের তীরে প্রাচীন কোনো বটবৃক্ষের তলে দাঁড়িয়ে সেই সাধক দূরদৃষ্টিতে দেখে নিয়েছিলেন তাঁর ভবিষ্যৎ। নদী-তীরবর্তী প্রান্তেই গড়ে তুলেছিলেন তাঁর আস্তানা - সাধনক্ষেত্র। বিপুল ধনসম্পত্তির অধিকারী হয়েছিলেন, তবু মানুষের কাছে তিনি 'জমিদার' হয়ে ওঠেননি, হয়ে উঠেছিলেন কেরামতের অধিকারী এক দেবদূত - যিনি মন্ত্রবলে সারিয়ে দিতে পারেন যে কোনো দুরারোগ্য ব্যাধি। কোন শক্তিতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ঈশ্বর? - জিন্দাপির? তাঁকে ঘিরে গড়ে ওঠা অলৌকিক সব আখ্যানে বুজরুগি কম নেই, কিন্তু সেসব তো মানুষেরই কল্পনা, শাহ্ চাঁদ এর কীর্তি নয়। তিনি হলেন রক্তমাংসের সেই মানুষটি, যাঁর অন্তরদৃষ্টি মানুষের শরীর ছাড়িয়ে অন্তরের গভীরে, অন্তরীক্ষ থেকে ভবিষ্যলোকে প্রবাহিত হয়ে যেত। তাঁর কেরামতির গৌরবগাথা দশ বিশটা গ্রাম ছাড়িয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে পৌঁছেছিল। লোকমুখে পির শাহ্ চাঁদ কালে কালে হয়েছেন শাচান।
বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে কংক্রিটে বাঁধানো রাস্তা গিয়ে উঠেছে শাচান পিরের থানে। পিরের মাজারের সামনে বাইক থামিয়ে রানা আমাকে বলল, - কী রে দাদা, এখন চিনতে পারছিস? কত বছর আগে এসেছিস বল তো?
এসেছি সেই কোন ছেলেবেলায় - পাঁচ ছ বছর বয়সে। সেই ছেলেবেলায় কোনো কোনো দিন ভোররাতে ঘুমের মধ্যেই বিছানায় হিসি করে ফেলার পর আমার ঘুম যেত ভেঙে। তখন লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ঘুমনোর ভান করতাম। বিছানা উষ্ণ ভেজা টের পেয়ে দিদিমা বকাবকি করতেন, তারপর, শাচানপিরের নামে মানত করে কপালে জোড়হাত ঠেকাতেন। মাকে বলতেন, - মানত করেছি, সামনের শুক্রবার ওকে পিরের থানে নিয়ে যাস।
সেই মানত পালনের উদ্দেশে মা'র হাত ধরে, খালি পায়ে আলপথে আমার হেঁটে যাওয়া। তিন-চার কিলোমিটারের পথ। হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে পড়লে মা আমাকে কোলে তুলে নিতেন। পথে মাকরকলা গ্রামে পৌঁছে একটা পুকুরের ধারে গাছতলায় পা ছড়িয়ে বসতাম। ব্যাগ থেকে মুড়ি আর বেসনের বড়া বের করে মা খেতে দিতেন। পুকুরপাড়ে জলের ধারে গিয়ে দাঁড়ালে জাঁট নামক কোনো ভয়ংকর অলৌকিক জলজ প্রাণীর ভয় দেখাতেন। আর ঠিক তখনই আমার কেন জানি না, মনের মধ্যে লম্বা শুঁড়ওলা বিকট এক জলদানবের ছবি ভেসে আসত। শরীরে রোমাঞ্চ দেখা দিলে আবার হাঁটতে শুরু করতাম। অবশেষে শাচানতলায় পৌঁছে মা আমাকে পিরের মাজারের সামনে লম্বা করে শুইয়ে দিতেন। মাজারের দেখভাল করা বৃদ্ধ মানুষটি আমার সারা শরীরে চামরজাতীয় কিছু একটা বুলিয়ে দিতেন। তারপর মাজার থেকে ধুলোমাটি তুলে মা আমার মুখে দিতেন, মাথায় হাত বুলিয়ে বলতেন - হাঁ করো দেখি, বাবা শাচান সব ভালো করে দেয়। ওই ধুলোমাটি নয়, আমার লোভ ছিল শাচানপিরের উদ্দেশে দেওয়া শিন্নির ওপর। শিন্নি বলতে - গুড়ের পাটালি। আমি তৃপ্তি করে পাটালি চাটতে চাটতে আবার আল পথেই ফিরে আসতাম।
মাজারের বাইরে একখানি শতাব্দীপ্রাচীন মোলবৃক্ষ ডালপালা ছড়িয়ে বিরাজমান। সেই বৃক্ষের তলায় বসে আছেন এক বৃদ্ধা, সঙ্গে এক বালক। দেখে বোঝা যায় বৃদ্ধার নাতি। বৃদ্ধা তাঁর সঙ্গের একটি পলিথিন প্যাকেট থেকে মুঠোয় করে মুড়ি নিয়ে বাচ্চাটিকে খাইয়ে দিচ্ছেন। শাচানপিরের থানে এসেছেন, হয়তো মানত রক্ষা করতে। মূল মাজারে প্রবেশপথের বাঁদিকে একটি বড়ো কবর, আর ডান দিকে প্রায় টিলার মতো স্তূপাকার হয়ে আছে ছোটো-বড়ো হাজার-হাজার পোড়া মাটির ঘোড়া। ওগুলো শাচানপিরের থানে মানত পালন করে পিরের উদ্দেশে নিবেদিত। ওই স্তূপের তলায় জমে আছে শত শত বছরের হাজার-হাজার মানুষের কাতর প্রার্থনা। প্রবেশপথের ডান পাশটিতে বসে আছেন এক যুবক, বয়স বত্রিশ-তেত্রিশ এর কাছাকাছি। শাচান সাহেবের বর্তমান উত্তরপুরুষ হিসেবে এখন মাজার দেখভালের দায়িত্ব ওঁরই। অনেকটা আমাদের দেবমন্দিরের পূজারির মতো। যুবক আমাদের আহ্বান জানালেন। জিজ্ঞাসা করলাম, কী নাম আপনার?
- আরাজউদ্দিন চৌধুরী।
- ক'বছর সামলাচ্ছেন এই দায়িত্ব?
- এই তো ক'বছর। আগে আমার বাবা দেখাশোনা করত। এখন আমি করি।
আরাজউদ্দিনকে আমার এখানে আসার উদ্দেশ্য বললাম। বললাম, -- আরাজ, শাচানপির সম্পর্কে তুমি যা যা জানো, আমাকে বলো, এই মাজারের ইতিহাস আমি জানতে চাই।
আমার প্রস্তাব শুনে আরাজ খানিক ঘাবড়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল, - আমি তো বিশেষ কিছু জানি না। আমার নানা অনেক কিছু জানতেন।
- নানার কাছে যেটুকু শুনেছ, সেটুকুই বলো, আমি শাচানপিরের গল্প শুনতেই এসেছি।
আরাজ এবার একটু ভরসা পেয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ও আমাকে শাচানপিরের অদ্ভুত সব কেরামতির কাহিনি বলতে লাগল। একটা মাত্র কলা খেয়ে কীভাবে শাহ্ চাঁদ বারো বচ্ছর কঞ্চিদহের ভিতরে সাধনা করেছিলেন। কেমন করে ত্রিশ কেজি ওজনের শিকলের চাদর গায়ে জড়িয়ে দ'র তলায় তিনি সাধনায় মগ্ন থাকতেন, ফলে কুমিরে তাঁকে খেতে পারেনি। এখনও সেই ত্রিশ কেজি লোহার শিকল আর দস্তানা নাকি সযত্নে রাখা আছে, দর্শনার্থীরা চাইলে সে শিকল চুম্বন করে পুণ্য অর্জন করতে পারেন।
একবার শাচানসাহেবের ছয় ভাইকে মালদায় বন্দি করে রাখা হয়েছে। সেখানে মালদার কুতুব বংশের মেয়ে নাহিনাবিবি একজন সিদ্ধ মহিলা - তিনি জিদ ধরেছেন, তাঁকে কেরামতিতে যে পরাস্ত করতে পারবে, তাঁকেই তিনি বিবাহ করবেন। তো অনেকেই তাঁর সঙ্গে কেরামতি দেখানোর খেলায় হেরে গিয়ে বন্দি হয়ে আছে। পিতার আদেশে শাহ্ চাঁদ সেখানে গেলেন। যে বজরা করে তিনি সেখানে পাড়ি দিলেন, মালদার কাছে গিয়ে সেই বজরা কিছুতেই গঙ্গার তীরে পৌঁছাচ্ছে না, মাঝ নদীতেই ঘুরপাক খাচ্ছে। আসলে নাহিনাবিবি তাঁর সিদ্ধিবলে ততক্ষণে জেনে গেছেন যে শাচানসাহেব আসছেন বজরা করে। তো নাহিনা যত তাঁর মাথা ঘোরাতে থাকেন, বজরা ততই এক জায়গায় ঘুরপাক খেতে থাকে। শাচানসহেব সেটা বুঝতে পেরে শুরু করলেন তাঁর কেরামতি। তিনি তাঁর দুই আঙুলের ইশারায় নাহিনাবিবির মাথায় দুটো শিং সৃষ্টি করলেন এবং জানলার গরাদে আটকে দিলেন বিবির মাথা। বিবি আর মাথা নাড়তে পারেন না। বজরা এবার চলতে শুরু করল। শাচানসাহেবের কাছে কেরামতিতে পরাজিত হয়ে নাহিনাবিবি তাঁকে নিকাহ্ করলেন। নিকাহ্ করে, ছয় ভাইকে মুক্ত করে শাচানসাহেব একলখি ফিরলেন।
শাচানপিরের কেরামতির বর্ণনা দিতে গিয়ে আরাজের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, - শাচানসাহেবের বিয়ে তাহলে মালদার কুতুব বংশে হয়, তাই তো? আচ্ছা, মালদার সঙ্গে যোগাযোগ কি এখন আর আছে, মানে যাতায়াত ইত্যাদি?
আরাজ বলল, মালদার সঙ্গে এখানকার যোগাযোগ বেশ ভালোই। রেলমন্ত্রী থাকতে গনি খান চৌধুরী সাহেব কয়েকবার একলখি এসেছিলেন। এখনও মালদা মুর্শিদাবাদের কেউ কেউ এখানে আসেন।
আমি প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, - চলো, শাচান সাহেবের মাজার কোনটা দেখি।
আরাজ আমাদের নিয়ে মূল মাজারক্ষেত্রে প্রবেশ করল।
অলঙ্করণ - ছন্দক গুহ
Powered by Froala Editor