মেঝেতে ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে দলা পাকানো তারের কুণ্ডলী, অসংখ্য কাঠের টুকরো। না, যে কোনো কাঠ নয়। তা, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের দেহাবশেষ। অত্যন্ত যত্নে সাজানো-গোছানো মিউজিক স্টুডিও-ই এখন যেন পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। আফগানিস্তানের ন্যাশনাল ইনস্টইটিউট অফ মিউজিকের ছবিটা এমনটাই। বিগত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই আফগানিস্তানের বুকে ফুল ফুটিয়েছে সুরের। তবে তালিবানদের কাবুল দখলের পরেই নিমেষে বদলে যায় গোটা ছবিটা। তালা ঝোলে প্রতিষ্ঠানের দরজার। বর্তমানে অনিশ্চয়তার দোরগোড়ায় সেখানকার শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং শিল্পীদের ভবিষ্যৎ-ও।
১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১। দীর্ঘ ছ’বছর আফগানিস্তানে কায়েম ছিল তালিবান-রাজ। লাগু করা হয়েছিল শারিয়া বা শরিয়ত আইন। সেই আইনানুযায়ীই আফগানিস্তানে নিষিদ্ধ হয়েছিল সমস্ত রকমের সঙ্গীতচর্চা। এমনকি নিজের বাড়িতে বসে গান শুনলেও, তার পরিণতি হত ভয়ঙ্কর। কখনও প্রাণ দিয়েই তার দাম দিতে হত সাধারণ মানুষকে।
গত ১৫ আগস্ট তালিবানদের কাবুল দখল করার পরই যেন সেই ভয়াবহ স্মৃতিই ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আফগানিস্তান জুড়ে। কাবুল দখলের আগাম পূর্বাভাস পেয়েই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ মিউজিক ছেড়েছিলেন সেখানকার শিল্পীরা। কাবুলের মসনদের বসার পরই এই প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতা জাহির করা তালিবান। একদিকে যেমন ধ্বংস করা হয় অধিকাংশ বাদ্যযন্ত্র, তেমনই প্রতিষ্ঠানের শিল্পীদের যাতায়াতের জন্য বরাদ্দ গাড়িগুলিও সামরিক কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে তালিবান যোদ্ধারা।
ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে আফগানিস্তান সিল্করুটের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায়, বিভিন্ন সভ্যতা এবং সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটেছে আফগানিস্তানের। ভারতীয়, চৈনিক, আরবিয় এবং ইউরোপীয় সঙ্গীতের সংমিশ্রণে স্বতন্ত্র একটি সুর খুঁজে নিয়েছিল আফগানিস্তান। ২০০১ সালে তালিবান অধ্যায়ের সমাপ্তির পর সেই হারানো সুরেরই নতুন করে সন্ধান শুরু হয়েছিল এই আফগান প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে। সঙ্গীতচর্চা তো বটেই, পাশাপাশি নারী শিক্ষা উন্নয়ন এবং মহিলাদের অধিকারের স্বপক্ষে বারবার সওয়াল হয়েছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। আফগানিস্তানের প্রথম মহিলা অর্কেস্ট্রা ‘জোহরা’-রও জন্ম এই ইনস্টিটিউটেই। মাত্র মাস দুয়েক আগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বুকে ধ্রুপদী সঙ্গীতের সুরে ঝড় তুলেছিলেন ‘জোহরা’-র তরুণ মহিলা শিল্পীরা। আজ সকলেই তাঁরা গৃহবন্দি, নয় পলাতকা।
আরও পড়ুন
১ মাসে তৈরি ৪০ কিলোমিটার কাঁটাতার, আফগান-পরিস্থিতিতে অমানবিক গ্রিস
তবে তালিবান শাসন কায়েম হওয়ার আগে থেকেই বারবার সহিংসতার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাঁদের। সঙ্গীতচর্চার জন্য হুমকি, এমনকি নির্যাতনের শিকার তো হতে হয়েইছে, এমনকি শিল্পীদের প্রাণনাশের চেষ্টাও চালিয়েছিল তালিবানরা। ২০১৪ সালে এই ইনস্টিটিউটেরই একটি কনসার্টে বিস্ফোরণ ঘটায় এক তালিবান আত্মঘাতী। তাতে ভয়ঙ্করভাবে আহত হয়েছিলেন প্রতিষ্ঠানের অধিকর্তা আহমেদ নাসির সারমাস্ট। মাথায় এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে ঢুকে গিয়েছিল বিস্ফোরকের শার্পনেল। দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী থাকার পর সুস্থ হয়ে উঠলেও, হারিয়ে যায় শ্রবণশক্তি। তাছাড়াও আহত হয়েছিলেন একাধিক শিক্ষার্থী। তবে দমে যাননি সারমাস্ট। পরবর্তীতে ককলিয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্টের পর পুনরায় কর্মক্ষেত্রে ফিরেছিলেন তিনি। তালিবান রাজ কায়েম হওয়ার আগে পর্যন্তও তিনি দায়িত্ব সামলেছেন এই প্রতিষ্ঠানের।
আরও পড়ুন
শরীর অর্ধেক পুঁতে, ইট ছুঁড়ে হত্যা; ভয়াল স্মৃতি এলজিবিটি সম্প্রদায়ের আফগানদের
তালিবানরা যে আর গান করতে দেবে না, এমনটা স্বয়ং জানাচ্ছেন সারমাস্ট। আত্মগোপন করে থাকা সারমাস্ট নিজেও ত্রস্ত তালিবানদের হুমকিতে। তাঁর ঠিকানা খুঁজে পেলে যে, হত্যা পর্যন্ত করা হতে পারে তাঁকে— এ বিষয়ে সন্দেহ নেই কোনো। যদিও তালিবানের তরফে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, নতুন পর্যায়ে মধ্যযুগীয় চিন্তাভাবনার ইতি টেনে নতুন করে সবকিছু শুরু করতে চায় তারা। মহিলাদের শিক্ষাগ্রহণে অনুমতি দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছে তালিবান। শারিয়া বা শরিয়ত আইন মেনে দেশের কাজকর্ম চললে তাদের আপত্তি নেই কোনো। কিন্তু আদৌ কতটা ভরসাযোগ্য তাদের কথা? মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের আগেও যে তারা ঠিক এভাবেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল শান্তিচুক্তির। তারপর রাতারাতিই বদলে যায় তালিবানদের অবস্থান। এক্ষেত্রেও কি সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে আগামীতে? সেই উত্তর হয়তো দিতে পারবে সময়ই…
আরও পড়ুন
আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে রাজি, মানবিক সিদ্ধান্ত ব্রিটেনের
Powered by Froala Editor