১৯৪৭। সময়টা একদিকে মুক্তির, অন্যদিকে বিচ্ছেদের। দীর্ঘ ২০০ বছরের দাসত্ব থেকে মুক্তি পেল ভারত। স্বাধীন হল। কিন্তু, স্বাধীনতা এল কাঁটাতারের ওপর দিয়ে। দেশভাগ। শরণার্থী। উদ্বাস্তু। শব্দগুলো সেই তখন থেকেই আমাদের সঙ্গে জুড়ে গেল। দেশও যেমন আলাদা হল, তেমন আলাদা হল যোগাযোগ। একটা সময় কলকাতা ও অন্যান্য অংশের সঙ্গে রেলপথে যে নিবিড় যোগাযোগ ছিল ঢাকা, খুলনার, সেই যোগাযোগে চিড় ধরল। বন্ধ হল ট্রেন চলাচল।
অথচ, ট্রেন বলতেই মনে পড়ে চিরন্তন একটি দৃশ্য। শরতের সকাল। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে কাশফুল। ঝলমলে রোদের মধ্যে দিয়ে ছুটে যাচ্ছে দুজন কিশোর-কিশোরী। ভাই-দিদি। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ট্রেন দেখার জন্য। এক সময়, মেঘ কাঁপিয়ে এল সে। একরাশ কালো ধোঁয়া ছেড়ে সে জুড়ে দিয়ে গেল পুরো দৃশ্য। যেন একটা বন্ধন। একটা মৈত্রী।
দুই বাংলা যেন তেমন মৈত্রীর কথাই বলে। পশ্চিমবঙ্গ, আর বাংলাদেশ। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে কাঁটাতার, সে আজ বহুকাল হল। বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে বঙ্গ সংস্কৃতির দুই কেন্দ্র— কলকাতা আর ঢাকা। পথের পাঁচালির মতোই, তাদের মিলিয়ে দিত ট্রেন।
এরপর, ১৯৬৫-এর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধেও বন্ধ হল ইস্ট বেঙ্গল মেল, ইস্ট বেঙ্গল এক্সপ্রেস, বরিশাল এক্সপ্রেস। যোগাযোগ আরও নষ্ট হল। এল ১৯৭১। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি। দুই দেশের মধ্যে রেলপথে সীমিত পণ্য পরিবহণ চললেও, বন্ধ রইল যাত্রী পরিষেবা। দুই দেশের মধ্যে কথা চললেও, বাস্তবায়িত হল না সেটা।
কিন্তু কথায় বলে, মানুষ যেটা চায়, মুশকিল থাকলেও একদিন না একদিন সেটা পূরণ হয়। এখানে একটি মানুষ না, একাধিক মানুষের চাওয়া। সালটা ২০০৮। নববর্ষের শুভ মুহূর্তে দুই দেশের সেই যোগসূত্র স্থাপিত হল। স্থাপিত হল মিত্রতার যাত্রার। শুরু হল মৈত্রী এক্সপ্রেস। কলকাতা এবং ঢাকার মধ্যে এই ট্রেন চলাচলের প্রাক্কালে উপস্থিত ছিলেন ভারতের তৎকালীন রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব, প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, ভারতের তৎকালীন বাংলাদেশ হাই কমিশনার লিয়াকত আলি চৌধুরী প্রমুখ। ৬৫ জনকে নিয়ে যাত্রা শুরু হল মৈত্রীর। ৩৭৫ কিমির দূরত্ব মিলে গেল এক নিমেষে।
এরপর নদী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। ট্রেনের সংখ্যাও একটা-দুটো বেড়েছে। বেড়েছে যাত্রীর সংখ্যাও। অনেক বিতর্ক পেরিয়ে, ট্রেন ছুটছে দুই বাংলার গ্রাম-শহর-নদী পেরিয়ে। ঠিক যেন ‘পথের পাঁচালী’। অপু-দুর্গা অপেক্ষা করে আছে কাশের আড়ালে। হয়ত দেখছে, ইতিহাস ঠেলে, শত শত উদ্বাস্তুর স্মৃতি পেরিয়ে, দুটো শহর আবার জুড়ে যাচ্ছে। একটা ট্রেনের হাত ধরেই…