বিদ্যাপতির ভাষা এখনও ঘোরে কলকাতায়, মৈথিলী কবি ভাস্কর ঝা’র বসবাস এই শহরেই

মৈথিলী - শব্দটা শুনলেই মনে পড়ে কবি বিদ্যাপতির নাম। ঐশ্বর্যে ভরা এক ভাষা। এমনই আশ্চর্য ভাষার এক কবি রয়েছেন এই কলকাতায়। ভাস্করানন্দ ঝা, ভাস্কর ঝা নামেই কবিখ্যাতি। পেশায় ভাবা অ্যাটোমিক রিসার্চ সেন্টারের অফিসিয়াল লিংগুয়িস্টিক ডেপুটি ডাইরেক্টর। দীর্ঘদিনের কলকাতাবাসী মানুষটির চোখে কেমন এই কলকাতা? জানা গেল তাঁর মুখ থেকেই।

আপনার জন্ম কোথায়?

পারিবারিক সূত্রে আমি দারভাঙা জেলার খারকা বসন্ত গ্রামের মানুষ। জন্মও সেখানে।

কলকাতায় কীভাবে এলেন?

আসলে আমি মিথিলা ইউনিভার্সিটি থেকে ইংলিশ লিটারেচারে এমএ করি। পিএইডি করতে করতে মাঝপথেই ছেড়ে দিই কিছু কারণে। তারপর যেমন করে সবাই, আমিও সরকারি নানা চাকরির পরীক্ষা দিতে থাকি। তখন ভাবার একটা প্রোজেক্টে চান্স পাই, হায়দ্রাবাদে পরীক্ষা আর ইন্টারভিউর পর মুম্বাইতে যাই ট্রেনিং-এ। সেখান থেকেই আসি কলকাতায়।

ভাবার চাকরি আর কবিতা পাশাপাশি কীভাবে মেলালেন?

দেখুন, ইংলিশ লিটারেচার আমার সাবজেক্ট। ফলে সাহিত্যের প্রতি একটা টান তো ছিলই। আর ভাবার চাকরিও সেই ভাষা নিয়েই। ফলে খানিকটা সুবিধাই হয়েছে বলতে পারেন।

ইংরাজি ছেড়ে মাতৃভাষাকেই বেছে নিলেন কেন লেখার জন্য?

যতই ইংরাজি নিয়ে পড়াশুনো করি না কেন, মাতৃভাষার প্রতি একটা আলাদা আকর্ষণ থেকেই যায়। আর ভেবে দেখুন আমাদের মৈথিলী ভাষার নানা মণিমুক্তের কথা। বিদ্যাপতির বৈষ্ণব পদাবলি। ফলে মৈথিলীই আমার প্রথম পছন্দ হয়ে দাঁড়ায়। লিখতে হলে মৈথিলীতেই লিখব, প্রথম থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম।

পনেরো বছর কলকাতায় আছেন। কলকাতা নিয়ে আপনার মতামত?

কলকাতা আমার হৃদয়ের খুব কাছাকাছি থাকা একটা শহর। আমার নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলা সংস্কৃতির সে অর্থে কোনো তফাত নেই। একটা সময় তো আমাদের ভাষালিপিও প্রায় একইরকম ছিল। অবশ্য এখন খানিকটা সুবিধার জন্য আমাদের দেবনাগরী লিপিকে গ্রহণ করতে হয়েছে। তা ছাড়া যখন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি ছিল, তখন বাংলা-বিহার-ওড়িশা এক থাকার কারণে আমাদের খাদ্যাভ্যাস, প্রকৃতি প্রায় একইরকম। ফলে আমার নিজেকে প্রবাসী বলে মনেই হয় না কখনও। তাছাড়া কলকাতা অসাধারণ শহর। এখানকার সংস্কৃতি, লোকজন এত আধুনিকমনস্ক যে আমার কখনও নিজেকে পর বলে মনেই হয় না। আমার পরিচিত প্রচুর বাঙালি রয়েছেন, যাঁরা কবি-সাহিত্যিক। তাঁরাও আমাকে কখনও এটা ভাবতে বাধ্য করেননি যে আমি বাইরে থেকে এসেছি।

কলকাতার কবি-সাহিত্যিক ছাড়াও সাধারণ মানুষের সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?

কবি-সাহিত্যিক হোক বা সাধারণ মানুষ, সকলেই ভীষণ ভালো, সহজেই আপন করে নেওয়া মনোভাব তাঁদের। বাজার-দোকানে গেলেও দেখি তাঁদের ব্যবহার অনেকটা পাশের বাড়ির মতো, যেন কত দিনের চেনা।

শোনা যায় আপনার একটা কবিতা নাকি ফিলিপিন্সের টেক্সট বুকে পড়ানো হয়?

হ্যাঁ, এটা ঠিক। আমার একটা কবিতার ইংরেজি ট্রান্সলেশন ওখানকার এক হাই স্কুলে পড়ানো হয়। শুধু ফিলিপিন্স কেন, অস্ট্রেলিয়ান-ইন্ডিয়ান ইংলিশ পোয়েট্রি অ্যাসোসিয়েশনের একটি সমাবেশে যে আটজন ভারতীয় কবি নির্বাচিত হয়েছিলেন, আমি তাদের মধ্যে একজন।

বাংলা কবিতা পড়েন?

পড়ি বইকি!। শুধু পড়া নয়, অনুবাদও করি ইংরাজিতে। আগেই বলেছি, প্রচুর বাঙালি সাহিত্যিক আমার বন্ধু। তাঁরা আমাকে পড়তে দেন নানা লেখা। আমার অসুবিধা, আমি বাংলা পড়তে পারলেও লিখতে পারি না। এই যেমন হাওয়াকল পাবলিশার্স অনেক বাংলা কবিতার বইয়ের ইংলিশ অনুবাদ করায়। সেগুলো আমাকে করতে দেয়। তাছাড়া বিভিন্ন আড্ডায় বাংলার লেখকদের সঙ্গে আমার ভাবনার আদান-প্রদান হয়, অনেক কিছু শিখি তাঁদের কাছে। বললাম না, বাংলার মানুষ অনেক বেশি আধুনিকমনস্ক।

শেষ হল জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব। বিদ্যাপতির ভাষার কবি তখনও আমার সামনে। চারপাশের কবি-সাহিত্যিক মহলে এই ভাষার ছোঁয়া পাওয়া যায় না। অথচ বিদ্যাপতির লেখায় মুগ্ধ হননি এমন সচেতন পাঠক মেলা দুষ্কর। তাঁরই উত্তরসূরির বসবাস খাস কলকাতায় – কলকাতাবাসী হিসেবে কি আমাদেরও গর্ব হয় না খানিক?

More From Author See More